বাক্‌ ১৪৯ ।। একটি স্বাভাবিক মৃত্যু ।। রাহুল দাশগুপ্ত


 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ: মঙ্গলবার

But life is not a series of deeds. My life is my thoughts.

Gustave Flaubert

 

ভোরবেলার দিকে চেরাব হঠাৎ উঠে বসল। একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছে সে। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। কেউ কী ওর নাম ধরে ডাকছে? একমাত্র অনুরণন এইভাবে ওকে ডাকত। রোজ ভোরে এসে ঠিক ওর জানলার সামনে দাঁড়িয়ে ডাকত, চেরাব, চেরাব। ওর ডাকার একটা নির্দিষ্ট সুর ছিল। সেই সুরটা খুব পছন্দ ছিল চেরাবের। অনুরণন আর কোনওদিনই আসবে না।

 

Dead, but still with us, still with us, but dead. Donald Barthelme.

 

চেরাবকে ঘুমের মধ্যে কেউ তাড়া করেছিল। কে তাড়া করেছিল, চেরাব দেখতে পায়নি। শুধু প্রচণ্ড ভয়ে সে ছুটছিল। আর এইভাবে ছুটতে ছুটতে হঠাৎ সে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। সামনেই গভীর খাদ। চেরাবকে থামলে চলবে না। কেউ তাকে তাড়া করে আসছে। পেছনে একটা প্রচণ্ড অস্থিরতা। কিন্তু সামনেই বা সে এগোবে কোথায়? খাদের দিকে তো তাড়া করে আসছে। পেছনে একটা প্রচণ্ড অস্থিরতা। কিন্তু সামনেই বা সে এগোবে কোথায়? খাদের দিকে তো আর ছোটা যায় না। চেরাব কী করবে এখন? তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তার বুক খুব দ্রুত ওঠানামা করছিল। সে থামাতে চাইছিল ওই প্রবল স্পন্দন। কিন্তু পারছিল না। এতে তার ভয় আরও বেড়ে গিয়েছিল। তার সারা শরীর কাঁপছিল।

সেদিন সকালে ওর খাবার দিতে গিয়ে ঠাকুমা হঠাৎ কেমন থমকে গেলেন। তারপর বললেন, চাকরিটা তুই ছেড়েই দে। তোকে দেখে মোটেই ভাল লাগছে না।

পারছি না। আমি চাইছি। কিন্তু পারছি না। চেরাব মৃদু স্বরে বলল।

এ আবার কেমন কথা? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। যখন শুধু ইউনিভার্সিটিতে যেতি, কত ঝলমলে দেখাতো তোকে। আর এ কী চেহারা হয়েছে তোর?

চেরাব একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল, আমি নিজেই বুঝতে পারছি না, আমার কী হয়েছে। আমি খুব ভয় পেয়ে গেছি। কিন্তু ভয় পাওয়াকে আমি ঘৃণা করি। কয়েকটা লোক, যাদের আমি পছন্দ করি, তাদের সঙ্গেই আমাকে থাকতে হচ্ছে।

তুই তাদের ত্যাগ কর।

পারছি না। আমি বুঝতে পারছি, এতে আমার ক্ষতি হচ্ছে। আমি খুব সেনসিটিভ মানুষ। ওরা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। কিন্তু কী করতে পারি আমি? চাকরিটা আমি ছেড়ে দিতেই পারি। কিন্তু সবকিছুই যে আমাকে বিকর্ষণ করছে, তা নয়। এর মধ্যে যথেষ্ট আকর্ষণও আছে। আমি অনেক কিছু জানতে পারছি। চাকরিটা ছেড়ে দিলে, আমার জীবনের এই অভিজ্ঞতা অসম্পূর্ণ থেকে যাবেসেটা আমি চাই না...

অনুরণনকেও তুই ভুলতে পারছিস না, তাই না? ঠাকুমা বললেন। একসময় উনি পাহাড়ের মতো ভাত খেতেন। চেরাব চাই বলত। থালার উপর উঁচু হয়ে থাকত সাদা ভাত। তার দু-পাশে নানারকম ভাজা। ডাল, তরকারি, মাছ, চাটনি। ঠাকুমা খেতে খুব ভালবাসতেন। খাওয়াতেও। যত দিন যাচ্ছে, ততই যেন ওঁর খাওয়া কমে যাচ্ছে। আজকে উনি শুধু ভাত দিয়ে নিমপাতা ভাজা খাবেন। এটা ঠাকুমার একটি প্রিয় কম্বিনেশন।

চেরাব একটা বেগুন ভাজায় কামড় দিয়ে বলল, অনুরণন আমাকে অনেক কিছুই ভুলতে দেয় না ঠাকুমা। ওর মধ্যে নিরাপত্তার প্রচণ্ড অভাব ছিল। এটা একটা রোগ। আর বেশ ছোঁয়াচেও বটে! এই রোগটা ও আমাকে দিয়ে গেছে। কিন্তু আমি নিজেই বুঝতে পারছি না, এই চাকরিটা নিয়ে রোগটা আমি সারাচ্ছি, না কী বাড়াচ্ছি? আমি খুব কনফিউজড।

ঠাকুমা চমৎকার মুগ ডাল করেন। ভারী ভাল হয় খেতে। তিনি চেরাবের থালায় আরেকটু মুগ ডাল দিয়ে বললেন, আমার বাবা বলতেন, চাকরি মানে হল কাল্পনিক দাসত্ব। এতে একটা মানুষকে বাইরে থেকে যতই স্বাধীন মনে হোক, মনের মধ্যে আসলে সে সবসময় দাসত্ব করে চলে। নিজের ইচ্ছায় সে কিছুই করতে পারে না। তাকে শুধু অন্যের নির্দেশ পালন করতে হয়। তার মন, কল্পনার জগতও, তখন নিয়ন্ত্রিত হয় অন্যের ইচ্ছায়। তোরও সেই দশা। কিন্তু তুই এটা মেনে ইনতে পারছিস না। খুব স্বাধীনভাবে মানুষ হয়েছিস তুই। ভেতরে ভেতরে বিদ্রোহ করছিস। আর এটাই তোকে কষ্ট দিচ্ছে। তোর ভিতরে একটা ভয়ের জন্ম হচ্ছে। বিদ্রোহ করতে চেয়েও যখন কাউকে নিরন্তর আপস করতে হয়, তখন সে ভয় পেয়ে যায়। মনে রাখিস, ভয় থেকেই দুর্নীতির শুরু। আর যারা দুর্নীতি করে, তাদের আত্মমর্যাদা বলে কিছু থাকে না...

আমি তাহলে কী করব ঠাকুমা? চেরাব বলে। চাকরিটায় তো সত্যিই আমার তেমন দরকার নেই। আমি তো কোনও অ্যাপ্লাই-ই করিনি। ওরা সাধ করে যেচে...

ওসব বাদ দে। যা হয়ে গেছে, তা নিয়ে ভাবিস না। তুই তো ওদের ফাঁদে পা দিয়েছিস। ওদের খাঁচায় গিয়ে ঢুকেছিস। এখন ওরা তোকে একজন চাকর হিসাবেই দেখবে। ওদের চাকরি করছিস তুই। তুই চাইলেই বেরিয়ে আসতে পারিস ওই খাঁচা থেকে। পারছিস না কেন? কে তোকে বাধা দিচ্ছে? আসেল তুই নিজেই নিজেকে বাধা দিচ্ছিস। তুই চাইছিস না,  তাই তোর স্বাধীনতা নেই। মনে রাখিস, স্বাধীনতার জন্যও মানুষের একটা প্রস্তুতি লাগে। সেটা যখন তোর নেই, তখন আরও কিছুদিন দ্যাখ। নিজেকে আরও একটু প্রস্তুত কর। তারপর দড়ি কেটে বেরিয়ে আয়। এটাই তোর পক্ষে ভাল হবে।

ঠাকুমাকে দেখতে এখনও খুব সুন্দর। একসময় তিনি সত্যিই সুন্দরী ছিলেনচমৎকার ইংরেজি বলেন এখনও। ইংরেজিতে এম.এ। চেরাব ঠাকুমার দিকে একবার তাকায়। অনেক অভিজ্ঞতা তাঁর। বুদ্ধি প্রখর। আর বোধও গভীর। ঠাকুমার পরামর্শ ওর জীবনে খুব দামি।

চেরাব খাওয়া শেষ করে। মৃদুস্বরে বলে, ঠিক আছে। অন্তত সাতদিন তো দেখি...

 

অফিসে ঢোকার মুখে আবার সেই দুর্গন্ধটা পেল চেরাব। এই গন্ধটার উৎস সে বুঝতে পেরেছে। গতকাল রাতে  সমুদ্রের ধারে দময়ন্তীর হাত ধরে ঘুরতে ঘুরতে সে বলেছিল, অজিতেশ অফিসে থাকলেই আমি ওই গন্ধটা পাই।

সত্যি? দময়ন্তী একগাল হেসে জানতে চেয়েছিল।

একদম সত্যি।

ওই জন্যই গন্ধটা সবসময় থাকে। অজিতেশ তো সবসময়ই অফিসে থাকে। রাত সাড়ে বারোটা-একটার আগে বাড়ি যায় না। আবার ভোর ছ-টা-সাড়ে ছ-টার মধ্যে অফিসে চলে আসে। কয়েক ঘন্টার জন্য বাড়ি যায় মাত্র। হাসতে হাসতে বলে উঠেছিল দময়ন্তী।

চেরাব বলেছিল, তাহলেই দেখ, গন্ধটার হাত থেকে আমাদের রেহাই নেই।

দময়ন্তী সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, কিন্তু আমাদের একটু অবাকই লাগে। অত কী কাজ করে অজিতেশ?

সত্যিই কী অত কাজ রয়েছে? তোমার কী মনে হয়?

দূরে একটা প্রাচীন দুর্গ। সেদিকে তাকিয়ে চেরাব বলল, ওই দুর্গটার একটা অংশে দামি হোটেল হয়েছে। অন্য অংশটিতে একটা মিউজিয়াম তৈরি করা হয়েছে। কেন জানো?

নাঃ!

আমার পুঁথিতে আছে। আসলে ব্যবসা চাই, আবার গৌরবও চাই। তাই ওই দুর্গের দুটো মুখ। মিউজিয়ামে গেলে এই দেশের অতীতের কথা ভেবে তোমার গর্ব হবে। আর হোটেলে ঢুকলে সেখানে তুমি পাবে বর্তমানের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা। দেশে-বিদেশের রাষ্ট্রনেতা, ধর্মগুরু আর শিল্পপতিদের জন্য এলাহী ব্যবস্থা। অজিতেশও ওইরকম। ও ক্ষমতা ছাড়া কিস্যু বোঝে না। কিন্তু সেটা দেখায় আমাদের। নিচের তলার কর্মীদের। আর কাজ দেখায় বসকে। বস ওকে এমনি এমনি অত ক্ষমতা দেয়নি। নিজের আনুগত্য ও নিষ্ঠা দেখিয়ে বসকে ও বশ করে রেখেছে। আসলে ও কাজ কিছুই করে না। ওই বসে থাকাটাই ওর কাজ। ও শুধু গোটা অফিসে নজরদারি চালায়। অফিসের ব্যাপারে, কর্মীদের কাজকর্মের ব্যাপারে খোঁজখবর রাখাটাই ওর কাজ। সেগুলো ও বসের কানে পৌঁছে দেয়। ও হচ্ছে বসের কান। আর ওই ক্যামেরাগুলো বসের চোখ। ওকে এখন কর্তৃত্বের নেশায় পেয়েছে। বাড়িতে ওর মন টেঁকে না। ও অফিসে ছুটে ছুটে আসে দাপট দেখাতে, যে সুযোগ ওর স্বপ্নেরও অতীত ছিল, তার ব্যবহার করতে।

চেরাবের কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠেছিল দময়ন্তী।

আরও একটা ব্যাপার বুঝতে পেরেছে চেরাব। অফিসে দময়ন্তী থাকলে সে বেহালা শুনতে পায়। দময়ন্তী বোধহয় এখনও পৌঁছয়নি। তাই সে কোনও বেহালার শব্দ পাচ্ছে না। কিন্তু অজিতেশ আছে। তাই সে দুর্গন্ধটা পাচ্ছে।

আরও একটা ব্যাপার ঘটছে। অফিসের কাছাকাছি এলেই ওর এখন মন খারাপ হয়ে যায়। তখন বাতাস ভারি হয়ে যায়। অফিসের ছাদগুলো যেন আরও নিচু হয়ে আসে। আলোগুলো কমে আসে। করিডরগুলো সরু হয়ে যায়। মানুষগুলোকে শত্রুর মতো মনে হয়। সবাই যেন জামার আস্তিনে একটা করে ছুরি লুকিয়ে রেখেছে। সামান্য একটু অসতর্ক হলেই সেই ছুরি বার করবে। বিশেষ করে, নিজের পিঠটা নিয়ে সবসময়ই সাবধান থাকতে হয়। ওটা বাঁচাতে সবাই ব্যস্ত। আর ওখানেই ছুরির আঘাত পড়ে সবচেয়ে বেশি। এই অফিসে কোনও আনন্দ নেই কেন?

নির্ঝর আর স্পর্শ বসে গল্প করছিল। নির্ঝর বলছিল, তুমি খুব ভাল। তুমি খুব নিষ্পাপ। কিন্তু সবাই তো তার সুযোগ নিচ্ছে। এটা তুমি হতে দেবে কেন? কেন লোকে তোমার ভালমানুষির সুযোগ নেবে?

স্পর্শ চেরাবের দিকে তাকায়। নির্ঝর উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে ওঠে, আরে চেরাব যে! এসো, এখানে এসে বসো। চেরাব ওদের ওখানে গিয়ে বসে।

স্পর্শ বলে, আমি যে পারি না, নির্ঝর।

পারো না? কেন? তোমার আসলে কোনও সাহস নেই। আর তুমি অত্যন্ত নিরীহ। এগুলো কোনও কাজের কথা নয়।

আসলে, তুমি যা পারো, আমি সেগুলো পারি না। এবার একটু সাহস করেই স্পর্শ করে ওঠে।

আমি? কী পারি আমি? কী বলতে চাইছ তুমি? নির্ঝর বলে ওঠে। তার গলা গম্ভীর। আর বেশ দাপটও আছে।

সে তুমি ভালই জানো। স্পর্শ বলে। তোমাকে তো ছোটবেলা থেকে দেখছি।

নির্ঝর হঠাৎ চুপ করে যায়। তারপর বলে, হ্যাঁ, তুমি তো সবই জানো। কিন্তু অনেক কিছুই আবার জানো না। খুব ছোটবেলায় আমার বাবা আমাকে ছেড়ে চলে যান। অন্য একটা সংসার করতে। আমার তখন পাঁচ বছর বয়স। কী ভালই না আমি বাসতাম আমার বাবাকে। ওই অবস্থায় একটা শিশুর মনের অবস্থা কী হয়, তুমি বলতে পারবে?

স্পর্শ চুপ করে থাকে। চেরাব কৌতূহলী হয়ে ওঠে।

নির্ঝর বলে যায়, তোমার বাবাকে আমি দেখতাম। কী ভালই না বাসেন তোমাকে! কত যত্ন করে তোমাকে পড়ান। তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যান। তোমার আবদার রাখেন। পছন্দমতো জিনিস কিনে এনে দেন। আমার তখন মনের অবস্থা কী হত, কোনওদিন জানতে চেয়েছ?

স্পর্শ এবার মিনমিন করে বলে, তোমার জন্য আমার খুব কষ্ট হত নির্ঝর।

আর আমার কী হত? নির্ঝর বলে উঠল, আমার বুক ফেটে যেত। বুঝলে? ও জিনিস, তুমি বুঝবে না! কী দারিদ্র্যই না ছিল আমাদের! সেলাই করে আমার মা সংসার চালাতেন। এখন তাঁর বয়স হয়েছে। আমি বিয়ে করেছি। আমার একটি ছেলে আছে। গোটা সংসারটা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। আমি কী আমার বাবার মতো তোদের সবাইকে ভাসিয়ে দেব? ওরকম অমানুষ হতে তো পারব না! তাই একটু খোসামোদ করেই না হয় চলি লোকজনকে!

স্পর্শ হঠাৎ চেরাবের দিকে তাকায়। তারপর বলে, আর তুমি কেন এসেছ ভাই? তোমার বয়স আছে। সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। ইউনিভার্সিটির ছাত্র। এখানে, এই অন্ধকূপে পড়ে পড়ে মরছ কেন?

চেরাব চুপ করে থাকে। কী উত্তর দেবে এর?

এমন সময় চেরাব হঠাৎ বেহালার সুর শুনতে পায়। দময়ন্তী এসে ঢোকে ঘরে। দময়ন্তীর বাঁ-গালের দিকে তাকায় চেরাব। ঠিক ওখানেই কাল রাতে ও চুমু খেয়েছিল। কী করেছে দময়ন্তী ওই চুমুটা নিয়ে। মুছে দিয়েছে? না, এখনও ওটা ওখানেই রয়েছে? দেখা যাচ্ছে না।

নির্ঝর বলে ওঠে, আজ তো অগ্নিমিত্র আসবে না।

হ্যাঁ, শুনলাম। দময়ন্তী বলে।

আজ আমার চাপ কম। হাসতে হাসতে বলে নির্ঝর।

চেরাব ঠিক বুঝতে পারে না। সে কৌতূহলী হয়ে তাকায়।

নির্ঝর আবার বলে, আজ মোক্ষের ওপর খুব চাপ পড়বে। মকবুল আছে না! ওর তো আবার আমার ওপর আস্থা কম। কাজ দিতে চায় না।

ঠিক তখনই স্পর্শ বলে ওঠে, এসব কী বলছ, বলো তো? দুটো ইনোসেন্ট ছেলেমেয়ে সামনে বসে আছে।

তো কী হয়েছে? ওরা অফিসের কেউ নয়? অফিসের রাজনীতি ওদের বুঝতে হবে না? অগ্নিমত্র আজ নেই। কে আমাকে কাজ দেবে? মকবুল?

এটা তোমার ভুল ধারণা চেরাব। তুমি মকবুলের প্রতি অবিচার করছ। স্পর্শ বলে ওঠে।

সে তো তুমি বলবেই। নির্ঝর ভেঙিয়ে ওঠে, তুমিও তো মকবুলের চামচা। আর মোক্ষের কথায় ওঠো আর বসো। তোমাকে আমি চিনি না। অফিসের সবাই জানে, মকবুল পক্ষপাতিত্ব করে। নিজের পছন্দের লোককে সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেয়।

আর অগ্নিমিত্র কী সাধুপুরুষ? সে কিছু করে না? হঠাৎ হাসতে হাসতেই বলে ওঠে দময়ন্তী। চেবার দেখতে পায়, তার ভ্রূ দুটো কুঁচকে আছে।

আরে, সে তো তুমিই ভাল বলতে পারবে। নির্ঝর একটু বাঁকা সুরে বলে। কাল সারাদিন ও তোমার সঙ্গে যত কথা বলেছে, সারা জীবনে আমার সঙ্গে তা বলেছে কিনা সন্দেহ!

প্লিজ, তোমরা চুপ করো। আমার আর এইসব, এই অফিসের রাজনীতি... হঠাৎ তীক্ষ্ণ স্বরে বলে ওঠে স্পর্শ।

এই সময় অজিতেশকে দেখা যায়। বসের ঘর থেকে সে বেরোয়। সে ভেতরে থাকলে এসব কথা কিছুই হয়তো হত না। তাকে দেখেই নির্ঝর উঠে দাঁড়ায়। তার পিছন পিছন হেঁটে যায়।

অজিতেশ খুশির মেজাজেই আছে। কোঁকড়া চুলে হাত বুলিয়ে সে বলে ওঠে, অগ্নিমিত্র তো আজ আসবে না...

নির্ঝরের গলার স্বর পালটে গেছে। যেন মধু ঝরছে। সে বলে ওইজন্যই তো তোমার কাছে এলাম।

দু-জনের চোখে চোখে কী যেন কথা হয়।

অজিতেশ বলে, স্পর্শকে একটু পাঠিয়ে দিও।

স্পর্শ কিছুটা ভয়ে, কিছুটা সংকোচে জড়োসড়ো হয়ে অজিতেশের সামনে দাঁড়ায়। অজিতেশ কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে, এসব কী লিখেছেন? আপনি কী কোনওদিনও কাজ শিখবেন না?

স্পর্শ মৃদু স্বরে বলে, কিছু ভুল হয়েছে?

ভুল! অজিতেশ আবার চেঁচিয়ে ওঠে, আমার ইচ্ছা করছে আপনাকে কান ধরে ওঠবোস করাতে! কতদিন ধরে এই অফিসে আছেন আপনি? কতদিন ধরে? বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো কাজ শিখে যাচ্ছে। আর আপনি এখনও এইসব ভুল করে চলেছেন?

অফিসের পরিবেশ হঠাৎ বদলে যায়। গোটা অফিসটা যেন থমথণ করছে। সবাই কেমন ভয় পেয়ে গেছে। কুঁকড়ে গেছে। থতমত খেয়ে গেছে। একা নির্ঝর কেন জানি মিটিমিটি হাসছে।

ঠিক এই সময় মকবুল অফিসে ঢোকে। বরাবরের মতোই একটা নিশ্চিন্ত অথচ দৃঢ় ভাব তার। মুখের হাসিতে কৌতুক মেশানো। কিন্তু দেখলেই তাকে আলাদা করে চেনা যায়। এমনই তার ব্যক্তিত্ব! এমনই তার ওজন!

চেরাব আর দময়ন্তী একে অপরের দিকে তাকায়। শ্বাস ছাড়ে। একটু হালকা বোধ করে।

 

চেরাব নিজের মনে কাজ করছিল। এমন সময় মোক্ষ এসে বলল, তোমাকে একবার মকবুল ডাকছে।

ওকে দেখেই হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাল মকবুল। তারপর বলল, কাল সব ঠিক ছিল?

মকবুলের চেহারাটা একটু মোটার দিকে। ঠোঁটের ওপর সরু গোঁফ। চোখে চশমা। মকবুলের সামনে এলে বেশ একটু স্বস্তি পাওয়া যায়। ঘরে অজিতেশ নেই। নইলে স্বস্তির সঙ্গে একটা অস্বস্তি মিশে থাকত।

চেরাব বলল, চমৎকার ছিল। কিন্তু তোমাদের জায়গাটা আমার ভাল লাগেনি। বড় ঘিঞ্জি।

আমি একটা নতুন ফ্ল্যাট দেখেছি। তোমাকে একদিন নিয়ে যাব। তোমার পছন্দ হলে পাকা কথা দিয়ে দেব।

চেবার বুঝতে পারে, মকবুল ওকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে।

বউদি দেখেছে?

আরে ওই তো বলল, তোমাকে নিয়ে যেতে। তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছে ওর। বলল, দারুণ ছেলে।

চেরাবের অফিসটাকে ভাল লাগতে শুরু করেছে হঠাৎ। মকবুলের দিকে তাকিয়ে গলার স্বর নিচু করে বলল, তুমি শুনেছ বোধহয়, স্পর্শের সঙ্গে আজ সকালে কী হয়েছে!

নাঃ! কী হয়েছে? খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চায় মকবুল।

তোমাকে মোক্ষ কিছু বলেনি?

কই, না তো! মকবুল কৌতুহলী হয়ে উঠেছে। ও হয়তো জানে না। জানলে ঠিকই বলত চেরাবকে।

চেরাব সকালের ঘটনাটা বিস্তৃতভাবে মকবুলকে বলে। মকবুল কিছুক্ষণ গুম মেরে থাকে। তারপর বলে, ও, এ তো হামেশাই হচ্ছে। তবে ওই ব্যাটা অজিতেশ, ওকে একদিন আমি দেখে নেব।

মকবুলের মুখটা ক্রোধে কঠোর দেখায়। সে আবার বলে, তুমি জানো, ব্যাটা ছিল আসলে বডিগার্ড। বস ওকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। ও ছিল বসের আশ্রিত। বসের বাড়িতেই মানুষ। চাকর-বাকরের মতোই। এসব লোক কর্তৃত্ব পেলে মাথা ঘুরে যায়। ক্ষমতার নেশায় পেয়ে বসে এদের। এই ব্যাটাও নিজেকে খুব কেউকেটা ভেবেছে। ভুলে গেছে, ও নিজেই একটা চাকর! তবে ওকে আমি ছাড়ব না। শিক্ষিত ছেলেগুলোকে ধরে ধরে অপমান করবে, তাও আবার আমার চোখের সামনে, এ আমি সহ্য করব না।

ও এরকম করে কেন? চেরাব উসকে দিয়ে দেখতে চায় মকবুলকে।

ও ব্যাটা মানুষই নয়! মকবুল রাগে ফুটছে। শিক্ষার কদর ও কী বুঝবে! যার নিজের পেটে বিদ্যে নেই, সে করবে অন্যের কদর! বেশি ক্ষমতা দেখাতে এসেছে এখানে! ফুঃ!

কিন্তু আসল দোষী বোধহয় নির্ঝর। আমি কিন্তু দেখেছি। ও অজিতেশের কাছে যাওয়ার পরই...

আরে, জানি জানি। ওকে আমি খুব ভাল করে জানি। ওটা অগ্নিমিত্রের চামচা। আর অজিতেশকে গিয়ে তেল দেয়। অজিতেশের অনেক কাজও করে দেয়। ওই কারণে এই অফিশে ওর এত খাতির। অজিতেশ নিজে তো কোনও কাজই পারে ন। ওকে দিয়ে অনেক কাজ করিয়ে নেয়। অর তার বদলে নিজেকে ও মোক্ষের সমান ভাবতে শুরু করেছে। ও হবে মোক্ষের সমান! ফুঃ! মোক্ষের সঙ্গে ওর কোনও তুলনা চলে? অফিসের সেরা ছেলে ও। নির্ঝর সবসময় ওর সঙ্গে প্রতিযোগিতা লাগিয়ে রেখেছে। ওর নামে গিয়ে অজিতেশ আর অগ্নিমিত্রের কাছে লাগানি-ভাঙানি করে আসছে। আমার চোখের সামনেই তো সব ঘটছে। আমি কী কিছুই দেখতে পাই না? আমি কী জানি না, কার দৌড় কতখানি? এমনি এমনি এই চেয়ারে বসে আছি? ওকেও আমি দেখে নেব। ব্যাটা বেশি সেয়ানা হয়েছে!

মকবুল ফুঁসতে থাকে। চেরাব একটু অস্বস্তি বোধ করে। মকবুলকে এতটা উসকে দেওয়া বোধহয় ঠিক হয়নি। কিন্তু না দিয়েও উপায় নেই। এই একমাত্র লোক, যাকে অজিতেশ আর অগ্নিমিত্র একটু সমঝে চলে। নইলে বাকি অফিসে ওদের সন্ত্রাসে সবাই ব্যতিব্যস্ত। অবশ্য সবাই নয়। চেরাব দেখেছে, অনেকেই ওদের দুজনকে তোষামোদ করে চলে। কারণে-অকারণে তেল মারে। তারা বেশ শান্তিতেই আছে। তাদের সঙ্গে অজিতেশ আর অগ্নিমিত্র অনেক সময়ই হেসে হেসে কথা বলে। তাদের নানা সুবিধা পাইয়ে দেয়। তাদের নামে বসের কাছে গিয়ে প্রশংসা করে আসে। কিন্তু এই দু-টি লোকের সঙ্গে তার কোনওদিনও বনবে না। চেরাব এটা বুঝে গেছে। যারা মার্জিত রুচির নয়, তাদের সঙ্গে চেরাবের ঠিক বনে না। এই লোক দুটির মধ্যে কেমন যেন বন্যতা আছে। আদিম মানুষের সঙ্গে এই দুজনের অনেক মিল আছে। চেরাব যে মার্জিত রুচির মানুষদের সঙ্গে মেলামেশায় অভ্যস্ত, তাদের সঙ্গে এরা যেন ঠিক খাপ খায় না।

চেরাব আবার বলে, তাহলে নির্ঝর যে এসব করে, অগ্নিমিত্র প্রশ্রয় দেব বলেই?

মকবুল আবার ফুঁসে ওঠে। তারপর বলে, আরে, ওর কথা আর বোলো না। ওই আর একটা ছেলে! বসের ড্রাইভারের ছেলে ছিল ও। বসের নিজের কোনও ছেলেপুলে নেই। খুব ছোটবেলা থেকেই বসের বাড়িতে ওর যাতায়াত। বস ওকে চোখের সমানে বড় হতে দেখেছেন। পড়াশুনা হয়নি। ক্লাস এইট পাশ। বস ওকে এই অফিসের একটা মাথা করে ঢুকিয়ে দিয়েছেন!

বস কী সত্যিই ওকে নিজের ছেলেলর মতো স্নেহ করেন? চেরাব জানতে চায়।

আরে দূর! মকবুল উড়িয়ে দেয়। তারপর বলে, নিজের ছেলে আর ড্রাইভারের ছেলে কী এক হল? হয় কখনও? ও নিজে অফিসে ওসব প্রচার করে বেড়ায়।

অগ্নিমিত্রের বাবা এখনও বেঁচে আছেন?

নাঃ! কিছুদিন আগে তিনি ক্যানসারে মারা গেছেন। ওদের ফ্ল্যাটটাও বসই কিনে দিয়েছেন।

আর ওর মা?

মকবুল একটু থমকে যায়। তারপর বলে, তিনি আগেই মারা গেছেন। অনেকে বলে, ওই মহিলার সঙ্গে নাকি বসের, বুঝতেই পারছ! তারা সন্দেহ করে, অগ্নিমত্র বসেরই ছেলে! কিন্তু আমার তা মনে হয় না। দূর! বস যথেষ্ট মার্জিত রুচির। আর এটা তো একদম বর্বর প্রকৃতির। মোক্ষ অবশ্য বলে কী জানো? বসের মধ্যেও একটা বর্বর প্রকৃতির লোক লুকিয়ে আছে। আর অগ্নমিত্রের মধ্য দিয়ে সেই লোকটিই আত্মপ্রকাশ করেছে। আমি অবশ্য সেটা মানি না। আবার এমনও শুনেছি, অগ্নিমত্র নাকি একদম ওর মায়ের মতো দেখতে। ওই মহিলাও ছিলেন কালো, লম্বা, বন্য প্রকৃতির। তাই দেখেই বস আর নিজেকে সামলাতে পারেননি। বসের ড্রাইভারকে আমিও দেখেছি। বেঁটে, মোটা, নিতান্ত নিরীহ ও গোবেচারা একটি লোক। তার ওরকম ছেলে, ভাবাই যায় না...

চেরাব বুঝতে পারে, মকবুলের নিজের কথাতেই স্ববিরোধিতা আছে। সেটা সে নিজেও বুঝতে পারছে। কিন্তু কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। মকবুল সুফি সাহিত্য নিয়ে ডক্টরেট করেছে। আর অজিতেশ আর অগ্নিমত্র? একজন ক্লাস এইচ পাশ, অন্যজন ক্লাস নাইন। মকবুল কিছুতেই এদের নিজের সমকক্ষ ভাবতে পারে না। এদের সে অনেক নিচু চোখে দেখে। কিন্তু বস এদের অফিসের সর্বেসর্বা করে রেখে দিয়েছে। মকবুলের পাশে বিপুল ক্ষমতা দিয়ে বসিয়ে রেখেছে। বস এই তিনজনকে তিনটি ভিন্ন কারণে ক্ষমতা দিয়েছেন। মকবুল তাঁর কাজটা তুলে দেবে। তার মতো যোগ্য আর কে-ই বা আছে? অজিতেশ গোটা অফিসকে শাসনে রাখবে এবং তার আনুগত্য নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। আর অগ্নমিত্র? সে কী বসের নিজের ছেলে? এটাই মানতে পারে না মকবুল। তার ভেতরে একটা গোপন কষ্ট আছে। বস ওকে চটাবেন না ঠিকই। কিন্তু ও-ই অজিতেশ আর অগ্নিমিত্রের বিরুদ্ধে কী করতে পারছে?

চেরাবের হঠাৎ মনে পড়ে যায়। সে বলে, তোমার বই দুটো এনেছি।

মকবুলের মুখের ভাবটা হঠাৎ পালটে যায়। উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে বলে, তোমাকে আমি এটাই জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম।

চেরাব বই দুটো নিয়ে আসে। মকবুল খুব খুশি হয়। তারপর বলে, অনেক ধন্যবাদ তোমায়। একটা কথা ছিল... চেরাব কৌতূহলী হয়ে তাকায়।

মকবুল বলে, আমি মোক্ষকেই পাঠাব ভেবেছিলাম। কিন্তু মত বদলে ফেলেছি। এ কাজ তুমিই পারবে। স্টেট লাইব্রেরিতে চলে যাও। সেখানে প্রতি মঙ্গলবার একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক আসেন। তাঁর নাম, রুদ্রাক্ষ সান্যাল। নব্বইয়ের কাছাকাছি বয়স। সমস্ত চুল সাদা। বেঁটে। কিন্তু এখনও খাড়া হয়ে হাঁটেন। তাঁর কাছে একটা দুর্লভ পুঁথি আছে। সেটা জোগাড় করে আনতে হবে। সরকার ওটা প্রকাশ করতে চায়। তবে অবশ্যই ভেজাল করে। তোমাকেই আমি লেখার দায়িত্ব দেব।

পুঁথিটা কার লেখা?

ওঁরা ঠাকুরদার। তিনি মস্ত লোক ছিলেন। তোমাকে আমি পরে সব বলব।

দময়ন্তীকে সঙ্গে নিয়ে যাব? হঠাৎ মুখ ফসকে বলে ফেলে চেরাব।

একটু ভাবে মকবুল। তারপর বলে, দুজনকে একসঙ্গে ছাড়া মুশকিল। তার ওপর আজ অগ্নিমিত্র নেই। বিশেষ করে, অজিতেশ তো জানতে চাইবেই!

কথাটা বলেই যেন জ্বলে উঠল মকবুল। তারপর বলল, অজিতেশ! আমি ওকে থোড়াই কেয়ার করি। আমিও ওকে দেখে নেব। ঠিক আছে, দময়ন্তীকে সঙ্গে নিয়ে যাও। কিন্তু একটা কথা মনে রেখ। দময়ন্তী কিন্তু উঁচু ডাল ছাড়া বসবে না। একটু সতর্ক থেকো।

চেরাবের মুখে হঠাৎ বিষাদের ছায়া পড়ে। সত্যিই তো, এই অফিসে সে একটা নিচু ডাল ছাড়া কিছুই নয়। সেই ডালে দময়ন্তী বসবে কেন? দময়ন্তীকে কী সে একটু একটু করে বুঝতে শুরু করেনি? কিন্তু উঁচু ডালে ওঠার যোগ্যতা তো তারও আছে। তার মনে হল, ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস না করে এখানে সে কী করছে? এই চাকরিটা সে যে ছাড়তে পারছে না, তার পিছনে দময়ন্তী হয়তো একটা কারণ। কিন্তু তাকে ছাড়তে দময়ন্তীর এক মুহূর্তও লাগবে না!

চেরাব ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় লক্ষ্য করল, মকবুল মন দিয়ে বই দুটোর মলাট দেখছে। ঠিক সেই সময় অজিতেশ ঢুকছিল। কড়া চোখে একবার চেরাবের দিকে তাকাল। চেরাব মুখ ঘুরিয়ে নিল। যে মানুষ তাকাতে জানে না, তার দিকে সে নিজেও তাকাতে চায় না। তার রুচিতে বাধে।

দময়ন্তী পরে অবশ্য বলেছিল, তাকানো অনেক রকম হয়। তুমি বোধহয় জানতে না!

No comments:

Post a Comment