খিদে-সংসর্গ
১
দিনকয়েক লবণ পর্যন্ত চড়েনি। উনুনঘরের চোখে
উপুড় হয়ে আছে রাত। ভোর না হওয়া অবধি কেউই সেখানে ঢুকতে পারছি না। শুকিয়ে
আসছে মাটি। ঘুমিয়ে পড়ল মা?
চার পায়ে চার মহাসাগরের খোয়াব নিয়ে ছুটছি
বাবা আর আমি। হেঁশেলের খাক হওয়া চোখে ক'ফোঁটা নুনজল ছিটোলে
যদি, উনুনে একটা
গোটা সূর্য জ্বলে ওঠে...
২
প্রায় মাস-দুই পর, ভিটেময় ভুরভুর করছে কষা মাংসের খুশবু।
দুপুর নামতেই বাপ-ছেলে মিলে বসে পড়লাম পাত পেড়ে। গলা বেয়ে মহাসমারোহে গড়িয়ে
পড়ল লাল-সাদা তাল তাল পৃথিবী। চক্কর দিতে শুরু করল এতদিনের শুনশান পেটে। অগত্যা
জল খেলাম খানিক।
ওদিকে, ভ্রূক্ষেপ নেই বাবার। একমনে চেটে যাচ্ছে আঙুল ও তেলোর
চারপাশ। চর্বি-ঝোলের আঁটোসাঁটো প্রলেপে ভুখা তরোয়ালের মতো চালিয়ে দিচ্ছে জিভ। মা
হাসছে খিলখিলিয়ে। আমি দেখছি, দুপুর পেরিয়ে যেতে। বাবার
লম্বা ঢেঁকুর, কলজে-রঙের বিকেল হয়ে আরও রাঙিয়ে দিচ্ছে চরাচর...
৩
ডিমসেদ্ধ পেলে আর কিছুই চাইতাম না আমরা।
বাইরে তুলতুলে, সাদা জমি।
লাঙলের মতো দাঁত চালিয়ে দিলেই ম্যাজিক। ভেতরে উঁকি দিত সর্ষেফুলে মোড়া একটুকরো
বেহেশত। তবে আনমনা কামড় পড়লে তার অনেকটাই ঝুরঝুর করে পড়ে যেত ধুলোয়। মন খারাপ হত।
তিন ভাইয়ের নসিবে বরাবর লেখা থাকত একটা
ডিমই।
একদিন, হাতেকলমে ডিমসেদ্ধ ভাগ করা শেখালেন
বাবা। নরম সাদায় সরু সুতোর দু'খানি নিখুঁত কোপ। চেয়ে রইলাম অবাক হয়ে।
তারপর সেই ঝলমলে হলুদ স্বর্গ, তিনভাগের বদলে তিনগুণ হয়ে ছাপিয়ে গেল তিন ভাইয়ের
হাসিমুখ...
মেলা-সংসর্গ
১
'উঠব...' বলে বায়না জুড়তেই, বাবা আমায় আলতো হাতে বসিয়ে দিলেন এক কালো ঘোড়ার পিঠে। সাদা-কালো-লাল-নীল,
রকমারি কাঠের ঘোড়া সামান্য শূন্যে গোলপথে ঘুরে চলেছে অনবরত। পেলব
হাসিভরা চিৎকারের আওয়াজে সুর মেলাচ্ছি আমি। দূরে দাঁড়িয়ে হাসছেন বাবাও।
হঠাৎই খেয়াল হল, বাকি ঘোড়াদের পিঠ থেকে নেমে
গেছে সব্বাই। কালো ঘোড়াটি আমায় নিয়ে ঘুরছে আরও আরও জোরে। আর মধ্যিখানে ঘূর্ণি
বেঁধে রাখা পেল্লায় থামের বদলে, তুখোড় সহিসের মত এসে
দাঁড়িয়েছেন বাবা। ফাঁকা ঘোড়াগুলোয় একে একে সওয়ার হচ্ছে আমার নানান রঙের বয়সেরা...
২
আকাশ ছুঁয়ে নেমে আসত নাগরদোলা। তারপর মাটি শুঁকে সাঁ করে উঠে যেত
ফের। ভয় পেতাম খুব। সামনে কখনও বসে থাকতেন বাবা, কখনও মা।
চোখ বুজে চেপে ধরতাম হাত।
বাড়ি ফিরে ঘুম। ভোরবেলা দেখতাম, আকাশছোঁয়া
স্বপ্ন চুরমার হয়ে কীভাবে আছড়ে পড়েছে মেঠো দাওয়ায়। সবটা কুড়িয়ে নিয়ে আমার মুঠোয়
চেপে ধরছেন বাবা-মা। শুঁকতে শুঁকতে ঘুমিয়ে পড়তাম আবার...
এখন আর নাগরদোলায় ভয় পাই না একেবারেই...
ওহ্ অসামান্য । কী অসাধারণ লেখা। খিদে সংসর্গ ও মেলা সংসর্গ ১ দুর্দান্ত লাগল। এমন ভাবনাকে শ্রদ্ধা জানাই
ReplyDeleteঅসাধারণ লাগল । অনেক ধন্যবাদ এতো সুন্দর ছবি মেলে ধরার জন্য
ReplyDeleteআহা অন্তর! কলমের নিবটা এসে সরাসরি হৃদয়ে...
ReplyDelete