বাক্‌ ১৪৯ ।। অভিষেক মুখোপাধ্যায়

১.

 

রোদ

 

 

একটা ক্লান্ত রোদ পালাতে চাইছিলো

একজন গৃহহীন মানুষের মৃতদেহের ওপর থেকে।

 

ভাঙা অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে, পলিথিনে, 

ফুটপাথে জমে থাকা চাপ চাপ রক্ত

ঝলমল করছিলো 

সেই মরে আসা আলোর নীচে।

 

কয়েকটা দীর্ঘশ্বাসের মত কাক

এই রুগ্ন অবাস্তব প্যারাগ্রাফের ভেতর এখানে ওখানে

খামোখা বিস্ময়সূচক চিহ্নের মত স্থির।

 

আইকনোক্লাস্ট'রা হানা দিলো হাওয়ার ভেতর! 

একটা পুরোনো খবরের কাগজ 

এদিক ওদিক 

উড়ে বেড়াতে লাগলো

চন্ডাল আর কাঠুরেদের ভিড়ের মধ্যে।

 

সব দৃশ্য ঝাপসা হয়ে গেলো, 

সব অক্ষিবিভ্রম আবার সম্পাদিত হলো

একটা ফোটোকেমিক্যাল ধোঁয়াশার চাদরের নীচে।

 

ঠান্ডা পি.ভি.সি পাইপের ভেতর ফেলে দেওয়া একটা কয়েনের মত

পুরো বিকেলটাই পড়ে যেতে লাগলো

একটা অন্তহীন গোলকধাঁধার ভেতর দিয়ে।

 

দূরবর্তী ধাতব শব্দ কানে আসার অপেক্ষা 

মরে গেলো একসময়,

আর ক্রসফেডিং দৃশ্যের মত

অন্ধকার ঘনিয়ে এলো ধীরে ধীরে।

 

 

২.

 

কারা যেন‌ কিছুতেই ঘুমোতে পারে না

 

 

কারা যেন কিছুতেই ঘুমোতে পারে না

অস্থির পায়ের শব্দ শোনা যায় রাত্রির হাওয়ায়

হলদে বাল্ব জ্বলে ওঠে নোনাধরা অ্যাপার্টমেন্টের জানলায়

পরিত্যক্ত ওয়াশ বেসিনের শ্যাওলা সরীসৃপের মত‌ হিম হয়ে থাকে অন্ধকারে

কারা যেন অনেকদিন ভালো করে ঘুমোয় না

তাদের ফেলে দেওয়া সিগারেটের স্টাবে ভরে যায় বিশ্বচরাচর

 

ভাঙা দেওয়ালের গায়ে ঝাপসা হয়ে আসে অসংলগ্ন গ্র্যাফিটি

স্ট্রীটল্যাম্পের আলোয় পায়চারি করে চন্দ্রাহত ত্রুবাদরের দল

পুরোনো রক্তের দাগ কালচে হয়ে লেগে থাকে তাদের চশমার ঘোলাটে কাঁচে

কারা যেন‌ অনেকদিন ভালো করে ঘুমোয়নি

তাদের ছায়া মাড়ানোর ভয়ে

আমরা অক্লেশে পাড়ি দিয়েছি অসংখ্য আলোকবর্ষ

 

ভগ্নপ্রায় ক্যাথিড্রালে জমে আছে কয়েক শতাব্দীর অন্ধকার

দৃষ্টিহীন প্যাঁচার চোখের মণিতে জেগে আছে অনন্ত ছায়াপথ

বায়ুমন্ডল ভরে গেছে নিঃশব্দ‌ আর্তনাদে

কারা যেন অনেকদিন ভালো করে ঘুমোতে পারেনি

তাদের অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে করতে

আমরা কবে যেন অন্য পাড়ায় উঠে এসেছি।

 

 

৩.

 

বিতৃষ্ণার দাঁত

 

 

নেগেটিভ ফিল্মের আকাশ থেকে শব্দহীন তুষারকণার মত

অবিরাম ঝরে পড়ছে নিষিদ্ধ‌ হ্যান্ডবিল

পায়ের নীচের উপত্যকা যেন একটা প্রকান্ড খবরের কাগজ

সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছে মূকাভিনেতাদের গণ-আত্মহত্যা

অশুভ সাইরেনের তীক্ষ্ণ শব্দে ডুবে যাচ্ছে তাদের নক্ষত্রজাত উপনিবেশ

 

ইনফ্রারেড আলোর ভেতর পেরেক আর ভাঙা কাঁচ কুড়োতে কুড়োতে

খিলখিল করে হাসছে এক বেওয়ারিশ অপ্রকৃতিস্থ শিশু

লকআউট কারখানার গেটে টাঙানো হচ্ছে পর্নোগ্রাফিক ছবি

আর স্বেচ্ছায় গ্যাস-চেম্বারে ঢুকছে যত বিকলাঙ্গ মানুষ

 

মুখের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করে

আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই আমি দেখলাম

আমার জিভের কেন্দ্রস্থল থেকে গজিয়ে উঠছে একটা ভয়াবহ দাঁত

ইঞ্চিখানেক বড় হওয়ার পর সেটা খসে পড়লো মেঝেতে

আর তার রেখে যাওয়া গর্তের ভেতর থেকে

হঠাৎ আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালো

একটা জঘন্য চোখ।

 

 

৪.

 

শেষ হয়ে গেছে সব কথা

 

 

একদিন ছেড়ে চলে যাবো আমি এইসব নষ্ট বিকেল

এই নীল ধোঁয়া, এই জানলা দরজা, চতুষ্কোণ স্বপ্ন মেঘ ধুলো

ক্লান্ত কিছু কাপলেট, লিখতে না পারা যত আলো অন্ধকার

চোখের নিমেষে আমি সব ফেলে চলে যাবো অন্য ঠিকানায়।

 

জ্যোৎস্নার ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে বদলে যাবে রাস্তাঘাট

দীর্ঘ টানেল বেঁকে যাবে কোনো নির্দিষ্ট নিয়তির দিকে

যেসব দীর্ঘশ্বাস একান্ত আমার ছিলো, তারা অন্য কারো

অস্তিত্বে বাসা বাঁধবে দাঁড়ি কমা ড্যাশ সেমিকোলনের মত।

 

রাত্রি জানো? জানো শহরের ফুটপাথ জুড়ে ছেঁড়া পলিথিন?

উদ্দেশ্যহীনতা জানো? অনিশ্চিত সকালের আলোর আশায়

যেদিকে দু'চোখ যায় যা থাকে কপালে বলে চলে যাওয়া জানো?

কিছুটা রিয়্যাল ফুটেজ। আর বাকি অংশ বেবাক সাজানো।

 

তবে সব মিথ্যে ছিলো? মুখোশের অন্ধকারে মুখশ্রী ছিলো না?

ছিলো না অন্তর্ঘাত? দু'জোড়া ঠোঁটের মাঝে চাপা চোরাস্রোত?

সহস্রাব্দের মত দীর্ঘ রাত, এলোমেলো সকাল ছিলো না?

ছিলো না ঘুমের মধ্যে শব্দহীন পড়ে যাওয়া অতলান্ত খাদে?

কিছুটা বিবাদ জানে, কিছুটা ভ্রাম্যমান হাওয়ায় হাওয়ায়

নক্ষত্রখচিত রাত হিসেব রেখেছে কিছু, বাকিটা অজানা

 

বেড়ে যাচ্ছে হাতের মুঠোয় রাখা কয়েনের ধাতব উষ্ণতা

কথা বলা শেষ হয়নি। তার আগেই শেষ হয়ে গেছে সব কথা।

 

 

7 comments:

  1. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  2. লিখতে না পারা যত আলো অন্ধকার সিধে হয়ে, ঋজু হয়ে দরজা খটখটায় আর বলে, এই যে এলাম। ঢুকতে দাও।

    ReplyDelete
  3. Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ! ভালো থাকবেন।

      Delete
  4. খুব ভালো লাগলো। মৃত্যু-চেতনার আকস্মিক অথচ এন্টি-ক্লাইমেটিক ঘটনাক্রমের মনকাড়া কোলাজ।
    বিতৃষ্ণার দাঁত দাগ কাটলো বেশী।

    ReplyDelete
  5. অনেক ধন্যবাদ! ভালো থাকবেন।

    ReplyDelete