বিগত কয়েক
দশকে পেশাদার উপোসী'দের বিষয়ে মানুষের আগ্রহ অনেকটাই কমে গেছে। একসময় ব্যক্তিগত উদ্যোগেও এই ধরনের প্রদর্শনীর আয়োজন করা যেত,
রোজগারও হত বিস্তর, কিন্তু ইদানিং আর তা
সম্ভব নয়। তখন সময় ছিল আলাদা। তখন ক্ষুৎশিল্পীকে দেখতে গোটা শহর ভেঙে পড়ত; উপোস যত দীর্ঘ হতো, দর্শকের উৎসাহ যেত বেড়ে;
দিনে অন্তত একবার তাদের শিল্পীকে দেখতে আসা চাইই চাই; লোকে শেষ ক'টা দিনের জন্য মরসুমের
টিকিট কেটে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শিল্পীর খাঁচার সামনে বসে থাকত; এমনকি রাতেও চলত প্রদর্শনী, হলঘরের ভিতরে মশালের আলোয় পরিবেশ আরো জমাট হয়ে উঠত; দিনের বেলা আবহাওয়া ভালো থাকলে খাঁচা সমেত শিল্পীকে বের করে এনে রাখা হতো খোলা জায়গায়, যাতে শহরের কচিকাঁচারাও দেখার সুযোগ পায়; বয়স্কদের জন্য এসব ছিল নিতান্তই হালফিলের তামাশা, বাচ্চারা কিন্তু একে অপরের হাত শক্ত করে ধরে, হাঁ করে তাকিয়ে দেখত, কীভাবে কালো আঁটোসাটো পাতলুন পরা, পাঁজরসর্বস্ব লোকটা খাঁচার ভিতরে মাটিতে খড়কুটো বিছিয়ে বসে আছে, মাঝে মাঝে ক্লিষ্ট হেসে, অল্প মাথা নেড়ে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে, মাঝে মাঝে খাঁচার বাইরে হাত বের করছে, যাতে লোকে ছুঁয়ে দেখতে পারে সে কতটা রোগা
হয়ে গেছে, তারপর হাত গুটিয়ে নিয়ে ফের নিজের ভিতরে ডুব দিচ্ছে, যেন কারো প্রতি, কিছুর প্রতিই ওর মনোযোগ নেই; এমনকি খাঁচার ভিতরে যে একমাত্র
প্রয়োজনীয় সামগ্রী ওর ঘড়ি, তার টিকটিক
শব্দের দিকেও খেয়াল নেই, আধবোজা চোখে শূন্য দৃষ্টি, মাঝে মাঝে কেবল ছোট্ট একটা জলের গ্লাস থেকে চুমুক দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিচ্ছে।
দফায় দফায় দর্শক আসত, যেত। কিন্তু
তা ছাড়াও কিছু পাহারাদার নিযুক্ত থাকত, কোনো অজ্ঞাত কারণে তারা পেশায় সকলেই কসাই। একেকবারে তিনজন করে পাহারাদার পালা করে সেই শিল্পীর উপর নিরন্তর নজর রাখত, যাতে সে গোপনে কিছু খাওয়ার
সুযোগ না পায়। তবে
এই ব্যবস্থা ছিল নিতান্তই প্রথাগত, লৌকিকতার খাতিরে বহাল। ক্ষুৎশিল্পীদের সম্পর্কে যার সামান্য হলেও ধারণা আছে তিনি জানেন, একবার ব্রত শুরু হলে শিল্পী কোনো অবস্থাতেই, এমনকি জবরদস্তি করলেও খাবারের কণামাত্র মুখে তুলবেন না, কারণ সেটা তার শিল্পের অবমাননা। পাহারাদারেরা এতশত বুঝত না, তারা রাতের বেলা প্রায়ই নজরদারি ফেলে দূরে এক কোণায় গিয়ে জড়ো
হয়ে ভারি মনোযোগ দিয়ে তাস খেলতে লেগে যেত, শিল্পী যাতে সেই অবসরে সামান্য দুটো মুখে দেবার সুযোগ পায়। তারা ধরেই নিত, কিঞ্চিৎ উদরপূর্তির জন্য নিশ্চয়ই তার কিছু না কিছু গোপন
ব্যবস্থা থাকবে। শিল্পীর কাছে এর চেয়ে বেশি
পীড়াদায়ক আর কিছুই ছিল না,
উপোস অসহ্য ঠেকত এদের কারণে। এরকম হলে মাঝে মাঝে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে শিল্পী গলা ছেড়ে গান গাইতেন, যতক্ষণ পারেন। বুঝিয়ে দিতে চাইতেন, ওদের সন্দেহ কতটা ভ্রান্ত, কতটা অন্যায়। তাতে বিশেষ লাভ হতো না। নজরদারেরা দূরে বসে
তাস পিটতে পিটতে অবাক হয়ে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করত, মুখভর্তি খাবার নিয়ে ব্যাটা গান গায় কী করে! আর যেসব
সন্দেদপ্রবণ নজরদার খাঁচার গা ঘেঁষে বসে থাকত,
মশালের আলোর ভরসায় না থেকে আয়োজকের
দেওয়া ইলেকট্রিক টর্চ জ্বেলে নজরদারি করত, তারা ছিল শিল্পীর অনেক বেশি পছন্দের। টর্চের চড়া আলোয় তার মোটেই অসুবিধা হতো না। এমনিতেও তার ভালো
ঘুম হতো না, আর তন্দ্রার জন্য তো
কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। যে কোনো সময়ে,
যে কোনো আলোয়, এমনকি ভিড়ে ভরা গমগমে হলঘরের মধ্যেও তিনি একটু একটু ঢুলে নিতে পারতেন। অবশ্য তেমন পাহারাদার পেলে তিনি সারা রাত জেগে কাটিয়ে দিতেও রাজি; তাদের সাথে হাসি-ঠাট্টা করে, নিজের ভবঘুরে জীবনের গল্প বলে, তাদের গল্প শুনে - যেমন করে
হোক তাদের জাগিয়ে রেখে, তার খাঁচায় যে সত্যি কোনো খাবার
লুকিয়ে রাখা নেই সে বিষয়ে তাদের আশ্বস্ত করে, এইটুকু বুঝিয়ে দিতে চাইতেন
যে তিনি যেরকম উপোস করতে পারেন, তেমনটি আর কেউ করতে
পারবে না।
শিল্পীর সবচেয়ে সুখের মুহূর্ত উপস্থিত হতো সকালে,
যখন তিনি নিজের খরচে নজরদারদের জন্য ভারি নাশতার বন্দোবস্ত করতেন। রাতজাগা লোকগুলো সেই খাবারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। অনেকে বলত, এসব আসলে ওদের ঘুষ দেওয়ার পন্থা, কিন্তু সেসব কথা বিশেষ পাত্তা পেত না। আবার খানাপিনার
ব্যবস্থা না রাখলেও মুশকিল, এরকম ভারি
প্রাতরাশের আয়োজন ছাড়া, কেবলমাত্র সৎ নজরদারির স্বার্থে কেউ রাত
জাগতে রাজি হতো না, যদিও শিল্পী সত্যিই লুকিয়ে খাবার খান কিনা, সে বিষয়ে তাদের সন্দেহ থেকে যেত
ষোলোআনা।
অবশ্য এসব সন্দেহ
পেশাদার উপোসীদের শিল্পের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবেই জড়িত। দিনরাত সর্বক্ষণের নজরদারি করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়, ফলে উপোস যে সত্যিই কঠোর এবং
নিরবচ্ছিন্ন ভাবে চলেছে, একথা জোর দিয়ে বলা কারো পক্ষেই সম্ভব হতো না; কেবলমাত্র শিল্পী নিজে তা জানতেন। তার ব্রত
যে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সত্যি সৎভাবে পালিত হয়েছে, একমাত্র তিনিই ছিলেন তার সাক্ষী। তবু অন্য একটি কারণে তার কাছে পরিতৃপ্তির বিষয়টা অধরাই থেকে যেত। সত্যি বলতে, কেবল উপোসের কারণে তার এমন কঙ্কালসার চেহারা হয়নি। সেই চেহারা দেখে অনেকে প্রদর্শনীর ধারে কাছে ঘেঁষত না, কারণ সেই দৃশ্য সহ্য করা অনেকের কাছেই ছিল কষ্টকর। আসলে শিল্পীর মনের ভিতরে এমন কিছু অতৃপ্তি ছিল যার ফলে তার চেহারা ভেঙে গিয়েছিল। আর কেউ না
জানলেও শিল্পী নিজে জানতেন, উপোস করা আসলে পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ কাজ। একথা তিনি সর্বসমক্ষেই বলতেন, কিন্তু তার কথা কেউ বিশ্বাস করত না। কেউ কেউ
ভাবত তিনি বিনয় করছেন, অনেকে ভাবত - এ' নেহাত
মনোযোগ পাবার কৌশল, নয়তো ভাবত - এ এমন
একজন ঠগবাজ যে কিনা সহজে
উপোস করার কোনো ফিকির বের করেছে, আবার সে কথা ঘটা
করে বলে বেড়াচ্ছে। এই সবই তাকে
সহ্য করতে হতো, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সহ্য করার অভ্যাসও হয়ে এসেছিল, কিন্তু ভিতরে ভিতরে সেই অতৃপ্তি তাকে সর্বক্ষণ কুরে কুরে খেত।
উপোস যতই
দীর্ঘ হোক না কেন, একথা মানতেই
হবে, আজ পর্যন্ত একবারের জন্যও শিল্পী কখনও প্রদর্শনীর
শেষে স্বেচ্ছায় খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে আসেননি। তার ইমপ্রেসারিও দীর্ঘতম উপবাসের মাত্রা বেঁধে দিয়েছিলেন - চল্লিশ দিন। তার
বেশি সময় অনাহারের অনুমতি নেই, এমনকি বড় শহরে প্রদর্শনী হলেও নয়। উপোসের এরকম ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ করে দেওয়ার পিছনে যুক্তিগ্রাহ্য কারণও ছিল। পূর্ব অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, দীর্ঘস্থায়ী বিজ্ঞাপনের জোরে মোটামুটি চল্লিশ দিন পর্যন্ত মানুষের আগ্রহ ধরে রাখা সম্ভব। কিন্তু তার পর থেকে মানুষের
উৎসাহে ভাটা পড়তে থাকে, সহানুভূতি এবং সমর্থন - দুইই যায়
কমে। দুটি আলাদা নগর কিংবা দুটি আলাদা দেশের মধ্যে এই সময়সীমার কিছুটা পার্থক্য হয় ঠিকই,
কিন্তু গড়পরতা হিসেব - সেই চল্লিশ
দিন। চল্লিশতম দিনে ফুল দিয়ে সাজানো খাঁচার দরজা খুলে দেওয়া হতো, উৎসাহী দর্শকে হল ভরে যেত,
মিলিটারি ব্যান্ডের বাজনার মাঝে দুজন ডাক্তার খাঁচায় ঢুকে শিল্পীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতেন, এরপর মাইকে ঘোষণা করা হত সেই পরীক্ষার
ফলাফল, শেষে দুজন তরুণী এসে উপস্থিত হতেন যাদের কিনা শিল্পীকে ধরে ধরে মঞ্চ থেকে নামিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে; সেই বিরল সম্মান পেয়ে তারা অভিভূত; এরপর তাদের কাঁধে ভর দিয়ে শিল্পী
ধীরে ধীরে একটি ছোট টেবিলের সামনে উপস্থিত হবেন, সেই টেবিলে তার উপোস ভাঙার জন্য বিবিধ পথ্য জাতীয় খাবার সাজিয়ে রাখা থাকবে। প্রত্যেকবার এই পর্বে এসে শিল্পীর
জেদ যেত বেড়ে। হ্যাঁ, তার কঙ্কালসার হাত দুটি সেই দুই তরুণীর হাতে ভর দিয়ে থাকত
ঠিকই, কিন্তু তিনি কিছুতেই খাঁচা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে চাইতেন না। এখনই কেন
উপোস ভাঙতে হবে, এই চল্লিশটি দিনের পর? যখন তিনি
সেরা ফর্মে ছিলেন, কিংবা হয়তো তাও ছিলেন না, তখনও তো তিনি এর
চেয়ে অনেক অনেক বেশি সময় উপোস করে কাটিয়েছেন, এখন তবে কেন থেমে যেতে হবে? তিনি সম্ভবত সর্বকালের সেরা পেশাদার উপোসী, সম্ভবত কেন, নিশ্চিত ভাবেই তিনি এই শিল্পে শ্রেষ্ঠ, তার নিজের
রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়ার সুযোগ কেন তাকে দেওয়া হবে না? তিনি বিশ্বাস করেন, তার অনাহার সহ্য করার ক্ষমতা মানুষের কল্পনার অতীত, বিশ্বাস করেন তার এই ক্ষমতা আসলে সীমাহীন,
তা প্রমাণ করার সুযোগ তাহলে কেন তাকে দেওয়া হবে না? তিনি নিজে যদি আরো কিছুকাল খিদে সহ্য করতে পারেন, তার গুণমুগ্ধরা যদি তাকে এতই সম্ভ্রম করে, তাহলে তারা আরো কিছুকাল ধৈর্য্য ধরতে পারবে না কেন? তাছাড়া, তিনি পরিশ্রান্ত, এতদিন
খড়ের উপর বসে দিব্যি আরামে ছিলেন, এখন দেহভার তুলে সোজা হয়ে দাঁড়াতে হবে, উঠে গিয়ে দাঁড়াতে হবে সেইসব বিস্বাদ পথ্যের সামনে যার কথা ভাবলেও বমির উদ্রেক হয়, এই তরুণীরা এখানে উপস্থিত না থাকলে
তিনি হয়তো সত্যিই বমি করে ফেলতেন। অনেক কষ্টে ঘাড়ের উপর ভারি হয়ে ঝুঁকে থাকা মাথাটা উপরে তুলে মেয়ে দুটির চোখের দিকে তাকাতেন তিনি, কী সকরুণ, কী নিষ্ঠুর
দেখাত ওদের, শিল্পী নারাজ হয়ে মাথা নাড়তেন। তারপর ঠিক সেটাই হত যা প্রত্যেক
বার হয়ে থাকে। ইম্প্রেসারিও এগিয়ে আসতেন, তার মুখে কোনো কথা নেই, কথা বললেও তা ব্যান্ডের উচ্চকিত বাজনায় ডুবে যাবে,
শিল্পীর মাথার উপর ইমপ্রেসারিও নিজের হাত তুলে ধরতেন, যেন ঈশ্বরের আশীর্বাদ প্রার্থনা করছেন খড়ের উপর বসে থাকা এই ক্লিষ্ট, বলিপ্রদত্ত প্রাণীটির উপর (সেটা অন্য আরেক অর্থে সত্যি বটে); অতি সাবধানে, দুই হাতে শিল্পীর শুকিয়ে যাওয়া কোমর জড়িয়ে ধরে, তাকে তুলে ধরতেন, কায়দা করে আড়াল থেকে একটা ঝাঁকুনি দিতেন যাতে শিল্পীর দুর্বল শরীর এবং পা দুটি দৃশ্যত
টলে ওঠে, তারপর তাকে ঐ দুই তরুণীর
হাতে তুলে দিতেন। শিল্পী এবার বাধ্য হতেন আত্মসমর্পণ করতে, বুকের উপর নুইয়ে আসা তার মাথা টলমল করত; জীর্ণ শরীর; ফিক্ ধরে থাকা দুই পা মাটিতে লতপত করত,
যেন পায়ের নীচে শক্ত জমি খুঁজছে; পাখির পালকের মতো হালকা শরীরটা তার সম্পূর্ণ ভার ছেড়ে দিত ঐ দুই তরুণীর
মধ্যে একজনের উপর, সে বেচারি হাঁসফাস করতে করতে
বিপন্ন চোখে এদিক ওদিক তাকাত; এই বিরল সম্মান
যে এত গুরুভার হবে তা
সে আঁচ করতে পারেনি! মেয়েটি যথাসাধ্য চেষ্টা করত যাতে শিল্পীর গালে তার গাল না ঠেকে যায়,
তারপর বিফল হয়ে তার অন্য সঙ্গিনীর দিকে কাতর চোখে চেয়ে দেখত, অন্য মেয়েটি কেবল কাঁপা হাতে শিল্পীর অস্থিসার হাত ধরে আছে; উপস্থিত জনতা ওদের এহেন দুর্দশা দেখে সবিশেষ আমোদ পেত, কারো কারো চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসত; এই অবস্থা
যে হতে পারে - আগে থেকে
এমনটা আন্দাজ করে মঞ্চের পাশে একজন লোক নিযুক্ত থাকত, সে-ই শেষমেশ ঐ তরুণীর
উদ্ধারে এগিয়ে আসত। তারপর আসত সেই জঘন্য খাবার, ইমপ্রেসারিও তার কিছুটা শিল্পীর মুখে গুঁজে দিতেন, শিল্পী যেন খানিকটা ঘোরের মধ্যে বসে থাকতেন; তার শারীরিক অবস্থার দিক থেকে জনতার দৃষ্টি ঘোরাতে ইমপ্রেসারিও বিড়বিড় করে কীসব যেন বলতেন। শিল্পী এরপর ইমপ্রেসারিওর কানে কানে কিছু একটা বলতেন, ইমপ্রেসারিও সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে জনতার উদ্দেশে একটি টোস্ট উৎসর্গ করতেন, তার সঙ্গে সঙ্গত দিয়ে সাড়ম্বরে অর্কেস্ট্রা বেজে উঠত, এরপর আস্তে আস্তে ভিড় পাতলা হয়ে আসত, অনুষ্ঠান নিয়ে কারোরই কোনো অসন্তোষের কারণ থাকত না আর, কেবলমাত্র সেই ক্ষুৎশিল্পী
ছাড়া, একমাত্র তার মনেই কী যেন অতৃপ্তি
জেগে থাকত, বরাবরের মতো।
এভাবেই বহু বছর
বেঁচে ছিলেন সেই শিল্পী, উপোস করেন, আবার কিছুদিন সময় নিয়ে খানিকটা স্বাস্থ্য উদ্ধার করেই ফের লেগে যান প্রদর্শনী করতে। খ্যাতির, সম্মানের অভাব ছিল না, কিন্তু তবু কেন যে তার মনের
ভিতরের সেই চোরা অতৃপ্তি ক্রমাগত বেড়েই চলল, তা কেউ বুঝতে
চাইল না। কীসের অভাব তার?
এর বেশি আর কীই বা
চাইতে পারে একটা মানুষ? প্রদর্শনী চলাকালীন কোনো সহৃদয় ব্যক্তি হয়তো শিল্পীকে বুঝিয়ে বলতে চাইতেন, তার এই অবসাদ আসলে দীর্ঘ
উপোসের ফল, আর কিছু নয়;
সে কথা শুনে হঠাৎ সকলকে চমকে দিয়ে শিল্পী ক্ষেপে উঠতেন, খাঁচার গরাদ ঝাঁকিয়ে উন্মত্ত ক্রোধে চিৎকার করতেন। ইমপ্রেসারিও কাছে এই উন্মত্ততার দাওয়াই ছিল, তিনি তা
বেশ হৃষ্টচিত্তে প্রয়োগও করতেন। উপস্থিত জনতার কাছে তিনি শিল্পীর হয়ে ক্ষমা চাইতেন, স্বীকার করতেন দীর্ঘ অনাহারের কারণেই এই বিকার, ভরাপেট মানুষের পক্ষে তা না
বোঝাই স্বাভাবিক; এরপর কথায় কথায় তিনি বলতেন শিল্পীর অন্যান্য পাগলামির কথা; লোকটা দাবি করে যে সে চল্লিশ
দিনের চেয়ে অনেক বেশি সময় না খেয়ে থাকতে
পারে। এমত উচ্চাকাঙ্ক্ষা, এহেন কৃচ্ছ্রসাধনের সংকল্প নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য - তবে একথা
বলেই ইমপ্রেসারিও বের করে আনতেন পূর্বের প্রদর্শনীর ফোটোগ্রাফ। তাতে দেখা যেত, উপোসের চল্লিশতম দিনে শিল্পী কেমন মৃতপ্রায় হয়ে শুয়ে আছেন, সেসব ফোটোগ্রাফ আবার বিক্রিও হতো।
সত্যের এই অপলাপ,
এই মিথ্যের বেসাতি যদিও শিল্পীর কাছে অপরিচিত নয়, তবু প্রতিবারই তার কাছে তা অসহ্য ঠেকত। যে
অবসন্নতা জোর করে তার উপোস শেষ করে দেওয়ার ফলস্বরূপ এসেছে, সেই অবসন্নতাকে এখানে ঐ জবরদস্তির কারণ হিসেবে
প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। এই ভুল বোঝার
বিরুদ্ধে, অবুঝের এই দুনিয়াদারির বিরুদ্ধে লড়াই করা অসম্ভব।
বহুবার এমন হয়েছে, খাঁচার গরাদে হেলান দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে, বিনা প্রতিবাদে শিল্পী ইমপ্রেসারিওর কথা শুনেছেন, কিন্তু ফোটোগ্রাফগুলি বেরিয়ে এলেই গুঙিয়ে উঠে ফের নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বসে পড়েছেন খাঁচার ভিতরে খড়ের মেঝেয়, জনতা আশ্বস্ত হয়ে ফের খাঁচার কাছে ফিরে এসেছে তাকে দেখবে বলে।
এরপর কয়েক
বছরের মধ্যে উপোস-শিল্পের নাভিশ্বাস উঠল। এককালে যারা প্রদর্শনীতে গিয়ে শিল্পীর নানান পাগলামি চাক্ষুষ করেছেন, সেসব দৃশ্য স্মরণ করতে গিয়ে তারা নিজেরাই কেমন যেন হতবুদ্ধি হয়ে পড়তে লাগলেন। শুরুতেই উল্লেখ করেছি, কয়েক বছরের মধ্যেই, হঠাৎ যেন রাতারাতি পেশাদার উপোসীদের সম্পর্কে মানুষের উৎসাহে ভাটা পড়ল; এই বদলের পিছনে নিশ্চয়ই গভীর কোনো
কারণ থাকবে, কিন্তু তা নিয়ে কে
আর মাথা ঘামায়। কারণ যাই হোক, মানুষের এতকালের পেয়ারের ক্ষুৎশিল্পী একদিন হঠাৎ দেখলেন তার প্রদর্শনী জনশূন্য, আমোদসন্ধানী জনতা তাকে পাশ কাটিয়ে অন্য কোনো বিনোদনের দিকে চলে যাচ্ছে। ইমপ্রেসারিও শেষবার চেষ্টা করলেন, শিল্পীকে নিয়ে ইউরোপের এক শহর থেকে
আরেক শহরে ছুটে বেড়ালেন, মানুষের পুরোনো আগ্রহ যদি কোথাও এখনও জিইয়ে থাকে; কিন্তু সে গুড়ে বালি; মনে হল
কারা যেন ভীষণ ষড়যন্ত্র করে পেশাদারি উপোসের প্রতি এক প্রবল অরুচি জাগিয়ে তুলেছে সর্বত্র। এই পরিবর্তন
যে সত্যি রাতারাতি ঘটেছে তা নয়, এতকালের সাফল্যের ছটায় আসন্ন দুর্যোগের যেসব পূর্বাভাস,
যেসব উপসর্গ চোখে পড়েনি, এবার তা স্পষ্ট হতে লাগলো,
কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। ভবিষ্যতে হয়তো আবার পেশাদারি উপোসের প্রচল হবে, কিন্তু বর্তমানের বাসিন্দা যারা, তাদের জন্য স্বান্তনা কোথায়? ক্ষুৎশিল্পী কী করবেন এবার? বুড়ো হয়েছেন, নিজের সময়ে যে খ্যাতি
তিনি উপভোগ করেছেন, আপন শিল্পের প্রতি যেভাবে সম্পূর্ণ সমর্পণ করেছেন তার জীবন, সেখান থেকে সরে এসে গ্রামেগঞ্জে যে অন্য খেলা
দেখাবেন তার উপায় নেই আর। তার দীর্ঘদিনের
জুড়িদার সেই ইমপ্রেসারিওর কাছ থেকে বিদায় নিলেন তিনি, একটা বড় সার্কাসে যোগ দিলেন, সার্কাসের চুক্তিপত্রে লেখা শর্তাবলীর দিকে তাকিয়ে দেখতে পারলেন না, মরমে মরে যেতে হয় যদি!
এসব বড়
সার্কাস অত্যন্ত ব্যস্ত জায়গা, কত খেলোয়াড়, কত পশু,
কতশত যন্ত্রপাতি এই বহাল হচ্ছে,
আবার এই খারিজ। শিল্পীরও এখানে বহাল হতে
বিশেষ অসুবিধা হল না, তার খাঁই
বেশি নয়, দীর্ঘদিনের সুনাম আছে, বয়সের কারণে তার কাজের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই; হ্যাঁ, এমনটা মনে হতেই পারে যে বুড়ো খেলোয়াড় তার সেরা
ফর্ম খুইয়ে এসে এখন সার্কাসের এক কোণে একটা
নিভৃত ঠাঁই খুঁজছে, কিন্তু শিল্পী যখন জোর দিয়ে বললেন যে উপোস চালিয়ে
যাবার বিষয়ে তিনি এখনও বরাবরের মতোই পারঙ্গম, তাকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ দেখা গেল না। তিনি যখন
দাবি করলেন যে তাকে যদি
অনির্দিষ্টকালের জন্য উপোস চালিয়ে যাবার অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে তিনি আগের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়ে সমস্ত দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দেবেন, সে অনুমতিও সহজেই মিলল; যদিও সার্কাসের
অন্য পেশাদার খেলোয়াড়রা আড়ালে মুচকি হাসলেন, কারণ উৎসাহের আতিশয্যে শিল্পী একথা বলতে ভুলে গেছেন যে তার শিল্পের
বাজার আর আগের মতো
নেই।
শিল্পী কিন্তু সত্যি সত্যি বাস্তববোধশূন্য হয়ে পড়েননি।
তার খাঁচা যে মঞ্চের কেন্দ্রে থাকবে না, বরং তাকে
তার খাঁচা সমেত বাইরে সর্বসমক্ষে জন্তুদের খাঁচার পাশে রাখা হবে, একথা তিনি সহজেই মেনে নিলেন। খাঁচা ঘিরে উজ্জ্বল রঙের বড় প্ল্যাকার্ড লাগানো হলো, ভিতরের দ্রষ্টব্যটি ঠিক কী, তার বিবরণ দিয়ে। বিরতির সময়ে খাঁচায় বন্দী জন্তুগুলোকে দেখতে মানুষ ভিড় করে আসত, শিল্পীর খাঁচার সামনে এসে তারা মুহূর্তের জন্য থেমে যেত। হয়তো শিল্পীকে আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখতে চাইত তারা, কিন্তু পিছন থেকে আসা ভিড়ের ঠেলায় কারো পক্ষেই বেশিক্ষণ দাঁড়ানো সম্ভব হতো না। আর ঠিক
এই কারণেই প্রথম দিকে সার্কাসের বিরতিকালীন এই অবকাশটুকুর জন্য অধীর
আগ্রহে অপেক্ষা করলেও, শিল্পী ধীরে ধীরে এই সময়টার প্রতি বিমুখ হয়ে পড়লেন।
প্রথম প্রথম এই সময়টুকুর জন্য তার
তর সইত না, তার দিকে বয়ে আসা জনতার ঢল দেখে তার
শরীরে একটা শিহরণ খেলে যেত। অল্প সময়ের মধ্যেই লোকগুলোর ভাব-ভঙ্গি থেকে তার কাছে সত্যিটা পরিষ্কার হয়ে গেল, পুরোদস্তুর আত্মছলনা দিয়েও সে সত্যকে ঠেকিয়ে রাখা গেল
না, লোকগুলো সার্কাসের চিড়িয়াঘর দেখতেই এসেছে, আর কিছু নয়,
এবং কিছুতেই এই নিয়মের ব্যত্যয় হবার নয়।
এরপর থেকে লোকগুলোকে দূর থেকে দেখতেই শিল্পীর ভালো লাগতো। তারা খাঁচার সামনে এসে পৌঁছলে তাদের হল্লায়, গালাগালিতে কান পাতা দায় হতো। এদের মধ্যে আবার দুটি পরস্পরবিরুদ্ধ দল থাকত, একদল কিছুক্ষণ
দাঁড়িয়ে শিল্পীকে দেখতে চাইত, সত্যিকারের আগ্রহ থেকে নয়, গোঁয়ার্তুমির কারণে - শিল্পী এদের সবচেয়ে
বেশি অপছন্দ করতেন - আরেক দল
হুড়োহুড়ি করে শিল্পীর খাঁচা পেরিয়ে সোজা জন্তুগুলোর খাঁচার সামনে যেতে চাইত। ভিড়ের প্রথম ঢেউ পেরিয়ে যাবার পর দলছুট লোকগুলো আসত। এদের
কিন্তু শিল্পীর খাঁচার সামনে এসে যতক্ষণ ইচ্ছে দাঁড়াতে কোনো বাধা নেই, অথচ এরা শিল্পীর দিকে দৃকপাতমাত্র না করে, প্রবল তাড়ায় বড় বড়
পা ফেলে চিড়িয়াঘরের দিকে চলে যেত। কালেভদ্রে, শিল্পীর কপাল ভালো থাকলে, কোনো পিতা হয়তো সন্তানদের নিয়ে শিল্পীর খাঁচার সামনে এসে দাঁড়াতেন, আঙুল তুলে দেখাতেন, বিশদে এই দৃশ্যের অর্থ বোঝাতেন,
তার নিজের পুরোনো অভিজ্ঞতার কথা বলতেন, এর চেয়ে আরো
অনেক রোমাঞ্চকর সব নুমাইশ দেখার গল্প বলতেন।
শিশুগুলি আর কতটুকু বোঝে, তাদের স্কুলের ভিতরে বাইরে এই বিষয়ে
কোনো পাঠ তো বরাদ্দ নেই - পেশাদারি উপোসেরই বা তারা কী
বোঝে? তবু তাদের উজ্জ্বল দৃষ্টি দেখে মনে হতো, নতুন সময়, ভালো সময় হয়তো বা সত্যিই আসবে। শিল্পী
মাঝে মাঝে নিজের মনে বিড়বিড় করে বলতেন - চিড়িয়াঘরের এত কাছে
তার খাঁচাটা না রাখলেই বোধহয় ভালো হতো,
এতে করে মানুষের পক্ষে তাকে এড়িয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া বড়ই সহজ হয়ে পড়ছে। অন্যান্য অসুবিধার কথা ছেড়েই দেওয়া যাক - চিড়িয়াঘরের দুর্গন্ধ, রাতে জন্তুগুলোর
অস্থিরতা, তাদের খাদ্য হিসেবে বয়ে নিয়ে যাওয়া মাংসপিণ্ডের গা গুলানো দৃশ্য, সেসব ছিঁড়ে
খাবার সময় জানোয়ারগুলোর ঘোঁতঘোঁত শব্দ - এসব তাকে
নিরন্তর বিষণ্ণ করে তুলত। কিন্তু কর্তৃপক্ষের কাছে এই বিষয়ে অভিযোগ জানানোর সাহসও তার হতো
না; সত্যি বলতে, জন্তুগুলোকে দেখতে যাবে বলেই তবু তো লোকগুলো তার খাঁচার
সামনে দিয়ে যায়, একদিন হয়তো ওদের মধ্যেই কেউ শিল্পীর প্রতি আগ্রহী হবে! আবার, লোকগুলোর চিড়িয়াঘরের দিকে যাবার পথে তিনি যে একটি মূর্তিমান
বাধার মতো বসে আছেন, সেকথা কর্তৃপক্ষকে জানালে ওরা যে তার খাঁচা
তুলে নিয়ে গিয়ে কোথায় বসাবে তা কে বলতে
পারে।
ছোটখাটো একটি বাধা'ই তো তিনি, সন্দেহ নেই, দিন দিন
আরো ছোট হয়ে আসছিলেন। সময় বদলে যাচ্ছিল। সার্কাস কোম্পানি যে শিল্পীর দিকে মানুষের
দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে, সে বিষয়ে মানুষ সচেতন হয়ে উঠছিল।
ধীরে ধীরে সেই সচেতনতা থেকে এল খরিদ্দার-সুলভ ঔদ্ধত্য,
শিল্পীর বিরুদ্ধে চলে গেল জনমত। শিল্পী যতই দীর্ঘ উপোস করুন না কেন, তার সামনে
আর কোনো পথ রইল না,
বিশুদ্ধ অবহেলায় লোকে তাকে এড়িয়ে যেতে লাগলো। কাকে বোঝাবেন তিনি তার সাধনার কথা? যার এই বিষয়ে বিন্দুমাত্র বোধ নেই,
আগ্রহ নেই, তাকে তো আর ধরেবেঁধে
বোঝানো যায় না। খাঁচার বাইরে লাগানো সুন্দর প্ল্যাকার্ড ক্রমে নোংরা হয়ে এল,
অপরিষ্কার হয়ে এল লেখা, কাগজ ছিঁড়ে
ঝুলতে লাগলো; আগে ছোট্ট একটা নোটিস বোর্ডে উপোসের দিনসংখ্যা লেখা থাকত, রোজ যত্ন আগের সংখ্যা মুছে নতুন করে লিখে দেওয়া হতো। কয়েক সপ্তাহ পর থেকে সেই
সংখ্যা অপরিবর্তিত রয়ে গেল, কেউ আর গরজ করে
বদলে দিয়ে গেল না। শিল্পী কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন উপোস করেই
চললেন, যেমনটা তার এতদিনের স্বপ্ন ছিল। তার কোনো অসুবিধা নেই, অভিযোগ নেই, শুধু কেউ আর দিনের হিসেব রাখল না,
কেউ জানল না, এমনকি শিল্পী নিজেও নয়, কোন রেকর্ড যে তিনি ভেঙে
ফেললেন, নতুন কোন রেকর্ড গড়লেন, একথা ভাবলে বুকটা ভারি হয়ে আসত তার। মাঝে মাঝে দুই-এক জন লোক
পায়চারি করতে করতে খাঁচার সামনে এসে দাঁড়াত, ঠাট্টায় হোক, উপেক্ষায় হোক বা তাদের আপন নীচতায়,
শিল্পীকে জোচ্চুরির দায়ে অভিযুক্ত করত। শিল্পী চুপ করে থাকতেন, জোচ্চুরি তো তিনি করছেন
না, বরং তার প্রাপ্যটুকু থেকে তাকে বঞ্চিত করে জোচ্চুরি করছে এই দুনিয়া।
এভাবেই আরো অনেক
দিন কেটে গেল, এল শেষের সেই দিন।
এক পরিদর্শকের নজরে পড়ল ব্যাপারটা, তিনি তার সহকারীকে জিজ্ঞেস করলেন এত ভালো একটা
খাঁচায় ওরকম নোংরা খড় ভরে ফেলে রাখা হয়েছে কেন; কেউ তার উত্তর দিতে পারল না, খাঁচার সামনে রাখা নোটিশ বোর্ড দেখে একজনের মনে পড়ে গেল শিল্পীর কথা। লাঠি দিয়ে খড়ের ভিতর খোঁচাখুচি করতে সেই খড়ের গাদার ভিতরে শিল্পীকে পাওয়া গেল। পরিদর্শক জিজ্ঞেস করলেন, "এখনও উপোস চালিয়ে যাচ্ছ নাকি? আর কতদিন?" শিল্পী ফিসফিস করে উত্তর দিলেন, "মাফ করো।" শুধুমাত্র পরিদর্শক খাঁচার গরাদে কান লাগিয়ে সেই উত্তর শুনতে পেলেন, বললেন, "হ্যাঁ ঠিক আছে", শিল্পীর অবস্থা দেখে চিন্তিত মুখে মাথা চুলকে তিনি বললেন, "আমরা মাফ করলাম তোমায়।"
- "আমি তো বরাবর এটাই চেয়েছিলাম,
একদিন তোমরা আমার উপোসের তারিফ করবে।"
- "তারিফ করি তো।" পরিদর্শকের
অমায়িক জবাব।
- "কিন্তু তারিফ করা তো উচিত নয়।"
- "বেশ তবে, করব না। কিন্তু তারিফ করা উচিত
নয় কেন?"
- "কারণ উপোস করা ছাড়া আমার যে আর কোনো
উপায় নেই। করতেই হয়।"
- "আজব লোক বটে তুমি।" পরিদর্শক বললেন, "উপোস করা ছাড়া উপায় নেই কেন?"
- "কারণ..." শিল্পী এবার মাথাটা একটু তুলে ধরে পরিদর্শকের কানে কানে স্পষ্ট উচ্চারণে বললেন, "আমার পছন্দসই কোনো খাবার আমি কখনো খুঁজেই পাইনি। বিশ্বাস করো, যদি পেতাম, কোনো বায়না না করে চেটেপুটে
খেয়ে নিতাম।"
এই ছিল
শিল্পীর শেষ উক্তি। তার দুই চোখে তখনও লেগে ছিল উপোস চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প, যদিও সেই দৃষ্টিতে কোনো ঔদ্ধত্য ছিল না আর।
পরিদর্শক তার সহকারীদের
বললেন, "নাও, এবার পরিষ্কার করে ফেলো এসব।" ওরা খড়কুটো সহ শিল্পীকে কবর দিয়ে
এল। ফাঁকা খাঁচায় স্থান পেল একটা বাচ্চা চিতাবাঘ। এতকালের বিষণ্ণ খাঁচাটার ভিতরে এবার সেই বন্য প্রাণীকে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বেড়াতে দেখে চূড়ান্ত রুক্ষ হৃদয়ের লোকগুলোও কিছু স্বস্তি পেল। চিতাবাঘটা দিব্যি খোশমেজাজে দিন কাটাতে লাগলো। সার্কাসের লোক ঠিক দু'বেলা ওর পছন্দের খাবার দিয়ে যেত;
ওকে দেখে মনে হতো জঙ্গলের স্বাধীন জীবন হারিয়ে ওর বিন্দুমাত্র খেদ নেই;
ওর হৃষ্টপুষ্ট অভিজাত চেহারায় এমন চেকনাই এল, ও যেন স্বাধীন
ভাবেই আছে; ওর শক্তিশালী চোয়ালের আশেপাশে সেই আনন্দের
ছটা লক্ষ্য করা যেত; ওর গুরুগম্ভীর ডাকের মধ্যে এমন তীব্র
জীবনীশক্তির বিস্ফার ছিল যে তা সামনে
দাঁড়িয়ে শুনতে বুক কেঁপে উঠত। তবু লোকে সাহস করে
ওকে দেখবে বলে খাঁচার সামনে ভিড় জমাত, হাজার ঠেলাঠেলিতেও তারা সেখান থেকে নড়তে চাইত না।
অনুবাদক বাংলা ভাষা এবং ইংরেজি সাহিত্যের প্রাক্তন শিক্ষক। বর্তমানে ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যে নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণারত।
অদ্ভুত একটা অনুভুতি, শ্বাসকষ্ট, গলার কাছে দলা পাকানো কান্না .... আরো কত কিছু ...!!
ReplyDeleteশিক্ষিত হলাম। সমাজবদ্ধ জীব এসবের মানে বোঝেনি কোনোদিন। বুঝবেও না। বিরাট প্রাপ্তি এটুকুই বলতে পারি।
ধন্যবাদ বিদিশা। ভালো থাকুন।
Delete