সত্য বিষয়ক গহ্বরের পরিণতি
যাহা বলিব, সত্য বলিব, সত্য ব্যতীত
...
হাঃ হাঃ হাঃ ....
এই যে, এটা আদালত!
আচ্ছা?
কেন, জানেন না!
জানি তো।
তবে যে ধম্মের বই ছুঁয়ে ফাজলামো মারছেন? সামনে স্বয়ং ধর্মাবতার বসে
আছেন!
সাহস তো খুব?
এতে আবার সাহসের কী দেখলেন? ...আসলে যখন তখন হাসি পেয়ে যায় মাইরি। হাসি
চাপতে পারি না।
পারেন না? বেশ। ফল ভোগ করবেন তাহলে।
মা কালী বলছি ভাই, হাসি চাপতে বড্ড কষ্ট হয় যে...'সত্য' বিষয়ে স্বামী সত্যানন্দ ঠাকুর যা বলে গেছেন, তারপর আর কথা হয় না, মাইরি! শুধু হাসি পায়।
যেমন?
যেমন ধরুন, বউ ভালোবাসে ক্লিন শেভড। মানে, নিম্নাঙ্গের। আর প্রেমিকা বলে যত ঝাঁকড়া
কেশ, ততই তুমুল আশ্লেষ। ...এবার,
এখান থেকে 'মিথ্যা' শুরু হল। (এতদূর হালকা চালে বলতে বলতে, গল্পকার হঠাৎ বাঁক নিতে চান এক গুরুগম্ভীর
আগদ্যসম্ভব নাকানিচোবানির মগডালে। যা, আসলে পুরো ট্যাক্স ফাঁকি দেবার মতলব।)
সে যাই হোক। বলো, কেমন লাগছে?
কী?
এই যে, কথা বলা;... কত কথা তো বলছ...
সবই তো আসলে মুখের ভেতর থেকে আসে...
ওটা তো মেকানিজম। যান্ত্রিক কারসাজি। সেটা চালায় আসলে কে, ভেবেছ?
ভাবিনি তবে? আমি। অহং। সো অহম।
আচ্ছা।
না, আচ্ছা বলে চুপ করে গেলে হবে না! বলো, ঠিক কি না?
ঠিক, ঠিক...
।।দ্বিতীয় ছবি।।
দৃশ্যমান
সত্য আর গহ্বরের ভেতর শুয়ে থাকা সত্য কি পরস্পরের পরিপূরক না বিরোধী?
এখানে গহ্বর বলতে কি চারিপাশের অবস্থান থেকে অপেক্ষাকৃত নিচু জায়গা বোঝাচ্ছে?
না না, আসলে কী জানো তো, বলি শোনো, গহ্বর বলতে এখানে সাদা চোখের বাইরে যে পরত, তার বিষয়ে
কল্পনা করা যেতে পারে।
হুঁ...
তাহলে, প্রশ্নটা এবার ঠিক আছে?
কোনটা?
ওই যে, পরিপূরক নাকি বিরোধী?
ও...বলব। গল্পটা আর-একটু শুনি, তারপর বলছি।
...একদা এক
নগরীতে এক গরিব ব্রহ্মণ বাস করতেন। ...তিনি বোকা লোকদের গাঁড় মেরে নিজের সংসার চালাতেন।
দুই লাইন গল্প বলতে গিয়ে একটা নোংরা শব্দ দিলে তো বসিয়ে?
ঠিক আছে, ওই শব্দটা ফেলে দিয়ে অন্য শব্দ বসিয়ে নিন। ক্ষমা করুন, করুণাময়, এই আমি কান
মুলচি! কিন্তু পশ্চাদ্দেশ মানেও তো আমার কাছে গাঁড়-ই! আপনি যাই বলুন আমার কাছে গাঁড় হয়েই আসবে!
উঃ! নগরীতে গরিব ব্রাহ্মণ বাস করার কাহিনি কি এখনও চলছে মার্কেটে?
হুঁ। এরকম ছাতা লাগা, জং ধরা সবই এখনও চলছে... ভালো খায়...
গাঁড় বলার জন্য কয়বার চাবুক মারা হবে জানো?
চাবুক ধরা হাতখানা দুমড়ে ভেঙে দিব! কাকে আওয়াজ দিচ্ছিস বে!
আরে—এ—এ যা ! ইয়ার্কি মারছিলাম গো, কিসুই বোঝে না, পাগলা একটা!
গরিবও হতে হবে আবার বামুনও হতে হবে?
আরে খ্যাপা, গরিব না হলে ভিক্ষে জুটবে? দর্শক-পাঠকের আবেগের ভিক্ষা?
আর বামুন?
দেখো দেখি, দুঃখের জীবন যদি বামুনের না হয়, তাহলে সেই দুঃখ-কষ্ট কি কারও মনে দাগ কাটবে? চাঁড়াল ফারালের দুঃখু কষ্টের জীবনটাই স্বাভাবিক। তাই
না?
বেশ যাক, সত্যের অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখছি দিকভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছ। ...কথা হচ্ছিল, প্রাইমারি সত্য আর সেকেন্ডারি সত্য নিয়ে। বা, আপাত সত্য ও প্রকৃত সত্য
বিষয়ে। কিংবা বলতে পারি ইমিডিয়েট ও গ্র্যজুয়াল সত্য...
গ্র্যজুয়াল শব্দটির স্থানে 'ডিলেইড' বা 'রিমোট' বসালে
অভিঘাত আরও কেমন বদলে বদলে যাচ্ছে দেখো! ডিলেইড ট্রুথ, রিমোট ট্রুথ! আহা!
আচ্ছা, রিয়েলিটি না ট্রুথ, কী উত্থাপন করতে চাচ্ছ?
।।তৃতীয় ছবি।।
চামচ দিয়ে
নেড়ে নে, সুবল, চিনি ভালো করে মিশিয়ে নে বাবা...
তুমি নেড়ে দাওনি ছোটকাকি?
না রে, আমার তো চিনি ছাড়া, নেড়ে না বাবা...
তুমি চিনি খাবে না বলে পরের চিনি গুলে দেবে না ছোটকাকি?
ছি বাবা, কী বলছিস এসব!
আমি মাস পড়লেই প্রথম টিউশনির টাকা হাতে পাব ছোটকাকি...
তাই কী হল রে খ্যাপা?
তোমার হাতে পাঁচশো টাকা দিব মনস্থির করেছি গো, বিশ্বাস করো...
দিবিখন, তাড়া কিসের বাপ, দিবি। রোজগার বাড়ুক...
এই মা! ছোটকাকি,
চায়ে তো চিনিই দাওনি গো! গুলে গুলে হয়রান, চিনি থাকলে তো মিষ্টি হবে! যাহ তেরি!
দিইনি বাবা? মোটেই চিনি দিইনি? এমন কপাল, ছি ছি বাছা, কী করবি একদিন নাহয় খেয়েই
নে চিনি ছাড়া! বাপ আমার...
সুবল ভাবতে বসে। তাহলে কি,
১. এই প্রথম চিনি বিষয়ক ভুল করল ছোটকাকি
২. তাকে আলাদা করে চিনি (মিশিয়ে) দেবার ধকল নিতে পারছে/চাইছে না আর
৩. সুগারের রোগী ছোটকাকি ভুল করার ছল করে আজ নিজে চিনি খেল
৪. ঘরে কি চিনি নেই
৫. সুবলকে অন্ন গেলাতে এবার বিরক্তি লাগছে কি ছোটকাকির মনে... ইত্যাদি।
ছবি তুলে রাখলেও আসল কথা বোঝা যায় না। আসল কথা মনের ভেতর থাকে। মনের ভেতর
ব্ল্যাকহোল, ওই গর্তে সিঁদ মেরে ঢোকা প্রায় অসম্ভব, তাই সত্যের পরিণতি সহজ হয়
না। সত্য একা একা নিজে নির্বিকার ভাবে পড়ে থাকলে কী লাভ। যদি না কোথাও একবার দেখা
দেয়।
সুবল ভাবে, ছোটকাকি এবার মরে গেলেই পারে। কাকা তো সেই কবেই গেছে, তা বছর তিনেক তো হবেই। সেই
থেকে সুবলকে নিয়ে আসে ছোটকাকি। ধম্মসাক্ষী একটা আত্মীয় 'বেটাছেলে' সঙ্গে থাকলে, শরীরে এখনও
আবছা যৌবনের রেশ লেগে থাকা প্রৌঢ়া, সমাজের কুনজর থেকে রেহাই পায়। সবাই তাই
সুবলকে ছোটকাকির সঙ্গে থাকার উপযুক্ত ভাবে।
ছোটকাকি যদি চায়ে চিনি গুলে দিতে আর উৎসাহ পায় না, তবে বেঁচে থেকে লাভ কী
মানুষটার। মারতে হবে শালিকে! অনেকদিন ধরেই কেমন যেন একটা প্রতিষ্ঠান বিরোধী আবেগ সুবলের মনের ভেতর মাথা
চাড়া দিচ্ছিল থেকে থেকে; আজ একেবারে স্পষ্ট হয়ে দেখা দিল।
টিউশনির টাকায় বেশ চলে যাবে। এইমাস থেকেই হাতে টাকা পাবে। ওরাই বলেছে আরও
চারখানা গার্জেন বাচ্চা পাঠাবে। তারমানে, পরে পরে আরও বাড়বে আর বছর ঘুরতে না ঘুরতে
ছোটকাকির ফ্যামিলি পেনশনের চেয়ে ঢের বেশি কামাবে সুবল নিজেই।
শালা, চায়ে চিনি দিতে ভুলে গেল!
।।ছবি নম্বর চার।।
আদালতে গিয়ে
মিথ্যার জাল বুনতে হবে। এমন ভাবে সাজাতে হবে, যেন সাজানো বিষয়টাই সত্য
ঘটনা হিসেবে ঝলমল করে। ডকুমেন্টারি এভিডেন্স এক্ষেত্রে তেমন তো থাকার কথা নয়।
উইটনেস বিরল, আই উইটনেস একটিও নয়।
বই ছুঁয়ে ‘সত্য বলিব’ বলতে গিয়ে পেটের ভেতর কুলকুল করে হাসির
ফোয়ারা ওঠে। যেমন, ‘সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর’। যে প্যাকেটে ওই লেখা নানা ভাবে ডিজাইন করে, তারও হয়তো, তাদের মধ্যে
কারও কারও হয়তো হাসি পায় কিলবিল করে।
হাসি অনেক সময় চেপে থাকতে হয়।
...মারা
যেতেই রান্না মাংস ফ্রিজে তুলে রাখল নিঃশব্দে, নীরবে, দুঃখ মাখানো
মুখে। ...দু’দিন পরে সবাই আহা উহু করে চলে যাবার পর যুৎ করে গুছিয়ে
খাবে। হাফ কেজি খাসির মাংস সাড়ে তিনশো। আর তাছাড়া খাসি খেতে খুব ভালো লাগে
ছোটকাকির। নিজে চোখে দেখেছে, স্বপ্ন নয়, স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে ঘটনা, সুবল।
স্বপ্নের ভেতরেও রিকন্সট্রাকশন হয় ঘটনার, এবং তা পরবর্তী কালে সত্য হিসেবে গেঁথে
যেতে থাকে মনে।
ছোটকাকি বরাবরই খাসির মাংস
খেতে ভালোবাসে খুব। ...আচ্ছা তবে গল্পটা আর-একবার শুরু করা যাক। একদা কোনও
এক গ্রামে পরিতোষ ব্যানার্জি নামে এক ব্রাহ্মণ তাঁহার স্ত্রীকে লইয়া বাস করিতেন।
ব্রাহ্মণ দম্পতি নিঃসন্তান ছিলেন। তাঁহাদের মধ্যে যৌনটান ক্ষীণ হইয়া আসিলে দাম্পত্য-খিটিমিটি বিরামহীন হইল। তখন বামুন ও বামনি গোপনে পরস্পরের মৃত্যুকামনা করিতেন। ...কালক্রমে একদিন এরূপ উপস্থিত হইল, যখন বামুনের ইহকাল আচমকা শেষ হইবে। পূর্বাভাস আসে
নাই। ...সেইদিন বামুনের ঘরে বামনি যুৎ করিয়া খাসির মাংস রন্ধন করিয়াছেন ও বামুনের
গৃহাগমনের অপেক্ষা করিতেছেন। বামুন আইল না, তাঁহার মৃত্যু সংবাদ আসিল। সেই সংবাদ শ্রবণ করিয়া বামনি অন্যান্য প্রতিক্রিয়া করিতে করিতে খাসির ঝোল
ফ্রিজের যথাস্থানে তুলিয়া রাখিলেন।
পরে পরে যেমন আরও জানা যায় যে, ২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নীচে রাখতে হবে
লেখা থাকে যে ওষুধের প্যাকেটের গায়ে, তা আসলে ভারতবর্ষের কোনও এক উৎপাদন ইউনিট
থেকে বেরিয়ে নানা ঘাট ঘুরে শেষ অব্দি ক্রেতার হাতে তখন পৌঁছয়, ততদিনে অনেক
তাপ উত্তাপ জলবায়ু অবহেলা অনাদর ও অজ্ঞানতা পেরিয়ে এসেছে।
সেরকমই বহু কিছু জানা যায় ছোটকাকি, সুবল, তার ছোটকাকা সম্বন্ধে। আসলে
জানা কিছুই সেভাবে যায় না। সত্য নিজের মতো গর্তে শুয়ে থাকে। তার কোনও দায় নেই। সে
চোখের সামনে দেখতে পায়, বেশিরভাগ সময়ই তাকে নিজের মতো সাজিয়ে
নিচ্ছে মানুষজন, যদি আদৌ তেমন প্রয়োজন পড়ে। তা নইলে সত্য সত্যের জাগায় থাকে, কাহিনি
নিজের মতো গড়ায়।
...জজসাহেবের
সহবৎ এমন, তিনি কথা বলবেন না সহজে; অথচ তিনি মাঝে মাঝে কথা বললে এবং বাদী-বিবাদীর সাথে আলাপ করতে পারলে বিষয়টা একটু
হয়তো সহজ হয়। ...দুই উকিলের নানান কেরামতি চলে। দু’জনই
জানে, যত লম্বা টানবে, ততই ভাতের জোগাড় নিশ্চিত হয়। শেষে একদিন জজসাহেবের ‘কাছের’ উকিল জজসাহেবকে চা-নাস্তা
খাওয়ার প্রস্তাব দেয় ও কেসের নিষ্পত্তি ঘটে। এক্ষেত্রে কখনও কখনও আরও হয় যে, একপক্ষের উকিলও কিছু পেয়ে চুপ করে যায়। বা, আবার এ-ও
বিরল কিছু উদাহরণ কি ঘটেনি, যখন জজসাহেব টেন্ডার খুলে বসে গেছে, যে পক্ষের
উকিল বেশি টাকা হাগবে তারই গলায় বিজয়মালা।
এক্ষণে সে সকল কচকচি যাউক। ...গলায় মাংসের হাড় ফেঁসে মরেছে, এখানে এখন
আর একথা চালানো যায় না। কারণ, বিচারের সময় অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতকে
গুলিয়ে ফেলতে দেওয়া হয় না।
।।পাঁচ নম্বর ছবি।।
রিম-টাল সাইকেলের পেছেনর
চাকা লগবগ লগবল করে, পেছন পেছন যে যায়, তারই অস্বস্তি হয়। কী শালা
লোক, সাইকেলটাও মেরামত করে না! ওই সাইলেকের পেছনে তাকালে বিরক্তি, ওভারটেক করে বেরিয়ে যায়, অন্য কেউ কেউ, যারা এইসব
বাহানাবাজি সহ্য করতে পারে না।
কেমন বাহানা?
না, কী করব বাপ, অনেক খরচ সংসারে...
কী এমন খর কাকা? ওই তো দু’জনের সংসার!
তখন এইকথা শুনে সুবলের ছোটকাকা পরিতোষ ব্যানার্জি যুগপৎ নিশ্চুপ হইয়া যান।
পরবর্তীকালে কোনও একদিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এসে সুবলের ছোটকাকি রাধাকে অমায়িক
ভাবে জিজ্ঞাসা করেন, হ্যাঁ গো, শালা, তোমার হাত থেকে একেবারেই
বেরিয়ে গেছি আমি গো, তাই না? খুব কষ্ট হয় তোমার, রাধা? (লেখকের বোকা-চালাকি পাঠক ধরে ফেলবেন, এটাই অভিপ্রেত। ...এই যেমন, বর্তমান লেখক কিছু খুঁজে না পেয়ে শেষে সুবল আর ওর ছোটকাকির একটা পারভার্টেড
অধ্যায় যোগ করবে ভাবছিল। কিন্তু সংযত হয়; সম্পাদকের কথা ভেবে নয়, তিনি তো না
পড়েই ছেপে দেবেন; লেখক আসলে সংযত হল ঘোড়েল পাঠকের কথা ভেবে।)
রাধা বলে, সে তুমি করো গিয়ে যার সাথে খুশি, শুধু টাকাপয়সা নষ্ট কোরো না, মাঝবয়সী
পুরুষ দেখলে মাগীগুলো খালি টাকা খিঁচে শেষ করে দিবে। অনেক দেখলাম গো, আদিখ্যেতা
সহ্য হয় না।
পোস্ট অফিসের কেরানি আমি রাধা, টাকা আর কত পাই, যে উড়িয়ে দিব?
এখন তোমার অনেক বেতন, আর বেনামে ফিক্সড ডিপোজিট এর কারবার করো, রোজভ্যালি
না ছাইভ্যালি কী সব করো। শোনো, ওই দু’ নম্বরি কাজ করিও না বলছি, কম্পানি
ডুবে যাবে তখন গলায় দড়ি দিতে হবে!
...প্রসঙ্গক্রমে আরও বলা যায় যে, লোকটার
হালকা আলুর দোষ ছিল। এমনিতে খারাপ মানুষ ছিল, কেউ বলতে পারবে না। মহিলা সহকর্মীরা উপভোগ
করতেন বিষয়টা, কেননা তিনি হামলে পড়তেন না বা বিরক্তও করতেন না; শুধু মিঠে মিঠে ফ্লার্ট
করতেন। সবাইকে ফ্লার্ট করতেন, তাও নয়। উদাস মহিলাদের প্রতি তাঁর আকর্ষণ
ছিল, অল্পবয়সী মেয়েদের উপেক্ষা করতেন, তা সে যদি উদাস, তাও। ...মারা যাবার পর এমন সব প্রসঙ্গ আজ সহজেই
উত্থাপিত হয়।
।।ছয় নং ছবি।।
যেমন, ‘রোজ ভ্যালির লাখ লাখ মাল ওই বহিনচোদ জমাই
করেনি। আর, জমা করলেও বা কী!’ যেমন, ‘একটা শুকনো ডালে একটা আম
বসে ছিল, একদা’ এরকম কথাও উঠতে পারে, যদি সমবেত জনতার কখনও মেধা হয়।
জজ সাহেব শেষে কথা বলবেন: নিরীহ দেখতে আপনার ছোটকাকা তো অবৈধ আর্থিক লেনদেনের সাথে
জড়িত ছিলেন...
আমি ওসব জানি না, সুবল বলবে।
সরকার পক্ষের উকিল: আপনার ছোট কাকিমার কাছে সেই অবৈধ টাকায় কেনা অনেক সোনা ছিল।
সুবল: থাকতে পারে। জানি না।
সরকারি উকিল: তাহলে কীসের লোভে মেরে ফেলেন ভদ্রমহিলাকে?
সুবল: উনি মাংস খেতে খেতে মারা যান। গলায় হাড় আটকে, শ্বাসরোধ হয়ে...
ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাননি কেন?
উনি তো তার আগেই মারা গেছেন।
সেটা আপনার জানার কথা নয়, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাননি কেন?
লাভ ছিল না। মারা গিয়েছিল আগেই।
জানলেন কীভাবে?
নিঃশ্বাস পড়ছিল না। ঠান্ডা হয়ে গেছিল। চোখ থেমে গেছিল।
সত্যি বলুন। গল্পটা খুলে বলুন।
তখন সুবল বলে, সত্যি কি মিথ্যে তা বলতে পারব না। তবে গল্পটা হচ্ছে, একদা এক
নগরীতে এক গরিব বামুন তার বামনিকে নিয়ে...
জজ: হুঁ... বেশ বেশ... বলতে থাকুন...
সুবল: যেমন একজন রিকশাবালার জিম্মায় সকালের বাজার দিয়ে আপনি বন্ধুদের সাথে
আড্ডা মারতে কিংবা সেলুনে দাড়ি কাটিয়ে একটু মাসাজ করাতে বা বিপিনের চায়ের দোকানের
আড়ালে দু’ পেগ মারতে চলে গেলেন আর রিকশাবালা বেচারা খুব বাজে রাস্তায় রিকশা চালিয়ে, যত সাবধানেই
হোক না কেন, বাড়িতে যখন সবকিছু নামিয়ে দিয়ে এল তখন ব্যাগের ভেতরে অলরেডি কিছু ডিম ভেঙে
গেছে।
জজ: আচ্ছা। তো?
সুবল: সেটাই তো সবকিছু, জজসাহেব, এই সূক্ষ্ম
বিষয়গুলোই জীবনের টক আর ঝাল নির্ধারণ করে দেয়। এসবের থেকেই জীবনটা সহনীয় বা অসহ্য
হয়ে ওঠে। বিশ্বাস করুন স্যার, বড় ব্যাপারগুলোর চেয়ে ছোট ব্যাপারগুলো
অনেক দামি ও নির্ণায়ক। অথচ আমরা সেগুলো প্রায়ই জানতে পারি না ও পাত্তা দিই না!
সরকারি উকিল: বেশ মজার তো, আরও শুনব, ধর্মাবতার
যদি অনুমতি দেন। কিন্তু তার আগে বলুন তো, আপনি নিজের জন্য কোনও আইনজীবী রাখেননি কেন?
সুবল: আইনজীবী কি বাল ছিঁড়বে যে রাখতে যাব? আমি বাঁড়া সত্যি কথা আমার বাপকেও বলি না!
সরকারি উকিল: পয়েন্ট মে বি নোটেড মি লর্ড!
।।ছবি: সাত।।
সেদিন
মাংসটা খুব মন দিয়ে রেঁধেছিল রাধা, ছোটকাকি। গরিব গরিব চেহারার পরিতোষ
চক্রবর্তী অঢেল অবৈধ নিয়ে আসত ঘরে। কিন্তু পাছায় মুরোদ ছিল না। নিরামিষ জীবন ঘেঁটে
ঘেঁটে রাধার ঘেন্না হত। কেননা পুরুষের প্রগাঢ় চিন্তনে, তথাপি, সে, আর্দ্র হইত।
ফ্যাটাং ফ্যাটাং পুরোনো সাইকেল ঠেঙানো পরিতোষকে দেখলে গা ঘিনঘিন করত। যাহার মোতার নল বহুদিন সোজা হয় নাই। ফোঁটা ফোঁটা পেচ্ছাব পড়ে।
যাক সে কথা, মাংসটা বেশ যুৎসই হয়েছিল, কষতে কষতে দু’পিস খেয়ে বুঝেছিল রাধা।
এক্ষণে ছোটকাকি রাধা নাম্নী জনৈকা মধ্যবয়স্ক হইলেন।
সত্য কেনার টাকা সুবলের নেই। সুবল নিজের কাকার মতোই নিরীহ মুখ করে থাকে। বউ
পুরোনো হলে কাকা হেসে হেসে উদাস মহিলা কলিগদের সঙ্গে আলাপ করে। ...ভ্রম নিয়ে, তবে, সুবল মোটেও বাঁচতে চায় না। সে একটা সোজা জীবন চেয়েছে। তার বলে ফেলা কথাগুলো
ভবিষ্যৎ কাল থেকে অতীতে চলে যায়। কোনটা সত্যি, সুবল জানে
না। সকালের সত্যি দুপুরে অসত্য হয়ে রাত্রে মিথ্যে হয়ে যায়। বাথরুমে খিঁচিয়ে
খিঁচিয়ে ড্রেনেজ সিস্টেমের বারোটা বাজিয়ে মাধুরীর মতো মেয়েকে বিয়ে করতে চায়।
চায়ে চিনি দিতে ভুলে গেলে ক্ষমা করা যায় না, সুবল জানে। চা ও চিনি
প্রতীক মাত্র। এখানে, আসলে, দীর্ঘ ব্যক্তিজীবন কাজ করে ব্যাকগ্রাউন্ড
হিসেবে। কাকা মারা যায়, তিনদিন পরে, কাকা মারা যাবার দিন রান্না
করা, ফ্রিজে তুলে রাখা মাংস বের করে গরম ভাতের সঙ্গে খাওয়া হয়। এখানে, উপরে বর্ণিত
এই ঘটনায় আইনের কোনও বাধা নেই, তাই আদালতে উল্লেখ করা যায় না প্রসঙ্গটা। ...সুবলও ছোটকাকির সঙ্গে গরম ভাতে কাকা
মারা যাবার দিনের রান্না মাংসর ঝোল মেখে মেখে খাবার অভিনয় করেছিল।
সেও তবে অপরাধী হয়...
সে, নিপাত যাক! নিপাত যাক! বলে।
আজকাল চীনের দালাল কেউ নেই। চিটফান্ডের টাকা বড় বড় বাবু আমলা নেতায় লুটেপুটে
খায়। ...কাঠগড়ায় তবু আজ সুবল দাঁড়িয়ে আছে, অন্য কেউ নয়। ছোটকাকা নয়, ছোটকাকি নয়, নেতা
মন্ত্রী জজ উকিল কেউ নয়। দাঁড়িয়ে আছে সুবল। ...ওদিকে জেরা চলছে আর এদিকে সুবল ভাবছে
টিউশনি করে বস্তা বস্তা টাকা কামাবে, সেই বস্তা বস্তা টাকা সামাল দিতে, পাচার করতে সুন্দরী সেক্রেটারি পুষবে।
সাইকেল আর চালাবে না। শুনেছে শক্ত সিটে বারবার বিচিতে চাপ লাগলে ক্ষতি হয়, দাঁড়ায় না।
কথাটা সত্যি কিনা সে বিষয়ে অবশ্য তার মনের মধ্যে সন্দেহ থেকেই যায়।
No comments:
Post a Comment