বাক্‌ ১৪৯ ।। নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

 


·        বৃন্দাবনীর পাশে প্রাকৃত দুপর

·         

মাতৃগর্ভ থেকেই পতন। এই পতন পৃথিবীতেই হয়। তার অর্থ পৃথিবী একটা পতনের জায়গা। সকল পতিত পৃথিবীর বাসিন্দা। অবশ্য দুয়েকজনের উত্থানও হয়েছিলো—তাদেও মধ্যে বুরাক নামের একটা পঙ্খিরাজ ঘোড়া। তারপর অনেকদিন পর লাইকা নামের একটা কুকুর। ঘোড়া আর কুকুরের সঙ্গম থেকে জন্ম হয় একটা ঘুমপাড়ানিয়া গানের। সেই গানে পৃথিবী তন্দ্রাতুর হয়ে থাকে চিরদিন—নাঘুম, না জাগরণ। আর পৃথিবী দুলে মহিষের শিঙের উপর। এই ভারসাম্যই প্রকৃতিকে প্রকট করে।

 

সকল জল ভাঙে দ্বৈরথ, কোথাকার পাড় ভেঙে বছর বছর আসে একটি শাদা শরৎ। শরৎ আমার জন্ম ঋতু, তবু তাকে জানি না একদিনও। এইভাবে স›ধ্যায় ঘুমের ধোঁয়াশা আসে। ভাসায় অনতিদূর বনের কাফন। কাফনে বৃক্ষমূলের ঘ্রাণ অগ্নি। ঝিরঝির গানের মৃত্যু হয়। নিবিড় অশ্রু গীত পতঙ্গসম পাতার শরীরে। অদূরে ধোঁয়ার আকার রক্তকে জাগায় পুনর্বার। ভাদ্রের একটি দিন থমকে থাকে স›ধ্যার বুকে। কেবল কুকুরের বিহ্বল চিৎকারে গাঢ় হয় নিরালা। অসতো মা সৎ গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যের্মা অমৃতংগময়। কিন্তু আমি অসৎ আর মরণশীল হয়ে পৃথিবীকে দেখি প্রান্তরের ছায়ায়।

 

ঘুমের আগে স্বপ্ন পরিব্যাপ্ত। যাকিছু দৃশ্যমান ভাবি সারাক্ষণ গাছটির দিকে চেয়ে—গাছের ডালে ছিলো স্বপ্নের উপাদান। স্তব্ধ তারায় কারো মুক্তি মেলেনি। ওই সুর মহাশূন্যকে আহ্বান করেছে এই গহ্বরে। গহ্বর আমার চোখের নিষ্প্রভ শহর। পরিব্যাপ্ত হয়েই ছিলো। বাকি ছিলো ঘুমের নিশ্চুপ প্রতীক্ষা।আমরা মুহূর্তের জন্যে থেমেছিলাম; থেমে হেসেছিলাম। বন খুব দীর্ঘ ছিল একা। আমরা ছিলাম আর ছিল তিনটা কুকুর। আর অদূরে হরিণের ভিতর হরিণ ছিলো লুকোনো চপল। বুনো বুনো দেশে আমরা ভয়ে ভয়ে ছিলাম—নিজেদের ভয়ে। ওইপারে যাবো, চা খাবো, বসবো, অন্ধকার করে দেবে নিভু নিভু সন্ধ্যা। নৌকো আর নৌকো পুনরায়। আমরা আমাদের অধিকার অনুভব করেছিলাম একটি ধূসর এবং তুচ্ছ হাওয়ার শরীর আমাকে দেখছিলো অবাক। নীরবতা এবং আমরা আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস হিশেবে চিরন্তন। একটি তারে প্রাণ দুলছিলো, কারো স্বরমণ্ডলে, আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের নিভে যাওয়া আলোতে দৈবক্রমে আমিই ফুরিয়ে যাওয়া শেষ সত্য গান। এই গান অনেক দূরাগত। এবং অপর। যদি নিজেকে একশোবছর পিছনে নিয়ে গিয়ে একটি গাছের শিকড়ের সঙ্গে কথা বলতে পারতাম তবে পূর্ণরূপ অথবা সংহত অর্ধমৃত একটি মাছ এসে অস্ফুটচোখে বলে দিতো ভবিতব্য। দীর্ঘশ্বাস মানে এইখানে স্বাস্থ্যসংগীত।

 

তারপর? তারপর বটের ফলের থেকে চুরি করে কারো রূপ, হিমের রাতের মতো হয়ে আছি চুপ। সে বৃন্দাবনীর পাশে খুলে রাখে প্রাকৃত দুপুর, বটের ফল আর শূন্যতা। পাতালেও পাখি থাকে জেনে অজানিত কাকলি শুনে শুনে ভুলে যায় আয়ু।

 

জন্ম মানে সকল সময় পতন নয় এই জেনে আমার ভাবনা আরও মন্দ্র ও দ্রবীভ‚ত হতে থাকে। আসলেই তো জন্মের আগে তো কোথাও ছিলাম।


No comments:

Post a Comment