বাক্‌ ১৪৯ ।। বাক্-স্বাধীনতা : ব্যক্তিগত দর্শন -- নবম পর্ব ।। শুভদীপ নায়ক

 


 

বিশ্বজগতে মানুষমাত্রই তাঁর সমস্ত জীবন দিয়ে সত্যের সন্ধান করে চলে । মানুষের ব্যক্তিজীবন, সম্পর্কের অস্তিত্ব, প্রেম, লেখালিখির যাবতীয় অংশ, চিত্রকলা, চিত্রনাট্য, রাজনীতি, দর্শন ও চিন্তা-চেতনা,--এই সবগুলো মিলিয়েই  তাঁর পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে । ব্যক্তিজীবনে যে মানুষ ক্ষুদ্র হয়ে আছে, হয়তো সৃষ্টির কাছে তাঁর জন্য খুলে রাখা আছে দিগন্ত । আবার এমন মানুষও আছে যারা অন্তরে ও বাইরে, উভয়প্রকার দিকেই নিজেকে প্রসারিত করতে পারে । বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন যখন বলেছিল, বিজ্ঞানই সকল প্রশ্নের সমাধান দিতে পারবে । ঠিক তখনই বিজ্ঞানী হাইজেনবার্গ বললেন, বিজ্ঞান কোনও প্রশ্নেরই সর্বশেষ সমাধান দিতে পারবে না । বিজ্ঞান একটা পদ্ধতিগত পথে কিছুটা দূর পর্যন্ত সুরাহা দিতে পারবে, কিংবা উপায় বলে দিতে পারবে, কিন্তু ঘটনার শেষ ব্যাখ্যায় পৌঁছানো বিজ্ঞানের দ্বারাও সম্ভব নয় । জগতে এক আশ্চর্য নিয়ন্তা আছে যিনি সব ঘটনার শেষটাকে সঠিক বিচারে নিয়ন্ত্রণ করেন । সেই নিয়ন্তা ঈশ্বর কিনা একথা বিজ্ঞান স্বীকার করে না, কিন্তু সেই আশ্চর্য শক্তির স্বরূপ যে আছে, তার কথা আমরা সকল বিশ্বাসী অবিশ্বাসী মানুষমাত্রই মেনে নিই । অর্থাৎ,হাইজেনবার্গ তাঁর 'অনিশ্চয়তা তত্ত্ব' ( The Principle of Uncertainty)-এ দেখালেন পরমাণুর মধ্যে একটি ক্ষুদ্র ইলেকট্রনের প্রকৃত অবস্থান কিছুতেই জানা যাচ্ছে না, যদি না তার ওপর আলো না ফেলা হয় । আবার আলো ফেলতেই ক্ষুদ্র ইলেকট্রনটি সেই আলোর ধাক্কায় তার প্রকৃত অবস্থান থেকে সরে যাচ্ছে । অর্থাৎ, বস্তুর আড়ালে অতিক্ষুদ্র দশা পর্যন্ত সৃষ্টির একটা মৌলিকধর্ম বস্তুর অস্তিত্বকে শেষপর্যন্ত রক্ষা করে চলেছে এবং পদার্থবিদ্যাকে তা জানতে দিচ্ছে না । সেই আশ্চর্য ধর্ম চায়, সর্বশেষ সত্য পড়ে থাকুক অন্ধকারে, মানুষের জানার বাইরে । অর্থাৎ, প্রকৃত জ্ঞান আমাদের পক্ষে অর্জন করা অসম্ভব । আমাদের জীবনে লেখাপড়া ও নিরন্তর পড়াশুনো করার মূল লক্ষ্য হল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রকৃত জ্ঞানের দিকে ছুটে যাওয়া এবং, তা কখনওই পাব না জেনেও, সেই জ্ঞানার্জনের পথে পড়ে থাকা অভিজ্ঞতাকে নিজের জন্য সঞ্চয় করা । কোনও একটা জিনিস জানা নেই বলেই অপর জিনিসটা জানা যায় । কিংবা কোনও একটি জিনিস জানা আছে বলেই অন্যটি জানা যাবে না এমনটা বোধ হয় । সৃষ্টির রহস্যকে ভেদ করতে মানুষ বিজ্ঞানের সাহায্য নিল যেদিন থেকে, সেদিন থেকে মানুষ তার জীবনের উপায়গুলো খুঁজে পেল, কিন্তু সত্যকে জানা তার পক্ষে সম্ভব হল না । সম্পূর্ণ সত্যকে যদি কোনওদিন জানা সম্ভব হয়, তা হলে সেদিন বিজ্ঞানের কোনও মূল্য থাকবে না, ধর্ম ও বিশ্বাস--দুই-ই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়াবে । আমরা মানুষেরা যারা সর্বদা সত্য বলি, তারাও আসলে গোটা সত্য মেলে ধরতে পারি না । যা বলি, তা প্রকৃত সত্যের ভগ্নাংশ, কিংবা সর্বোচ্চভাবে তা অর্ধসত্য । বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন হল সেই সত্যকে অনুসন্ধান করার পথ মাত্র, সত্য নয় । প্রকৃত সত্য অসম্ভব, অবাস্তব, অজ্ঞেয় । মানুষের অর্জিত জ্ঞান মাত্রই অসম্পূর্ণ জ্ঞান ।

গ্রিক দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ পিথাগোরাস জ্যামিতির মাধ্যমে প্রমাণ করেছিলেন দুটি সমান জিনিসের মধ্যে মিল ও তফাৎ একইসঙ্গে থাকতে বাধ্য । দুটি সমান মাপের লোহার তার বা সুতো দিয়ে তৈরি বর্গক্ষেত্র ও বৃত্তের পরিসীমা একই হয়, কারণ পরিসীমা বস্তুর বাইরের চেহারা, আকৃতি নির্ধারক । অথচ তাদের দ্বারা(বর্গক্ষেত্র ও বৃত্ত) অধিকৃত ক্ষেত্রফল কখনওই সমান নয় । কারণ, ক্ষেত্রফল বস্তুর ভিতরের জিনিস । বস্তু কতদূর নিজেকে ছড়াতে পারে তার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয় বস্তুর ক্ষেত্রফল । তিনি গণিত দ্বারা প্রাপ্ত বস্তুর এই মৌলিকধর্মটি মানুষের জীবনদর্শনের সঙ্গে যুক্ত করে বললেন, মানুষের চেহারা হল পরিসীমা, যা ওপর থেকে সহজেই দেখা যায়, কিন্তু মানুষের মন, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, তা সর্বদাই মানুষের ভিতরের ব্যাপার । অন্তরে মানুষ যতদূর প্রসারিত, মানুষ হিসাবে সে ততটাই সত্যের নিকটবর্তী, এবং সত্য ঠিক ততটাই তার অবস্থান থেকে দূরবর্তী ।

     যে পার্থিব শক্তি আমাদের অভ্যন্তরে আগে থাকতে প্রবেশ করে তা আমাদের কাছে যেকোনও ঘটনার সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরে, যে ব্যাখ্যাটা আবার অন্যদের কাছে আলাদা রকমের । এই মনোজগতের উপলব্ধির যে চাহিদাগত ব্যর্থতা, তা থেকেই কামনার জন্ম হয় । দার্শনিক ও মনোবিজ্ঞানী জাঁক লাঁকা বলেছেন, শিশু যখন তাঁর নিজের কামনাকে নিজের মা-বাবার কামনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে, তখনই শিশুর পক্ষে সম্ভব হয় প্রকৃত সত্যের কাছাকাছি আসা । জগতের সবকিছুকে সে তখন যাচাই করতে থাকে নিজস্ব উপলব্ধির ভিত্তিতে । চাহিদার এই অসম্পূর্ণতা থেকেই একজন শিশু বড় হয়ে তার সন্তান-সন্ততিকে বলে, 'আমার বাপ-মা যা দেয়নি, তাই তোকে দিচ্ছি ।' লাঁকা জানান, যদি কোনও শিশুর সব বায়না মেটানো হত, তা হলে তার নিজস্বতার কখনও বিকাশ ঘটত না । অভাব ও অসম্পূর্ণতার বিরুদ্ধে লড়াই করে পদ্ধতিগতভাবে কীভাবে নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হয়, তার শিক্ষা কখনও সে জীবন থেকে সংগ্রহ করতে পারত না যদি তার সব বায়না শৈশবেই তার পিতামাতা পূরণ করে দিতেন ।

সত্যের স্বরূপ সন্ধানে ব্যক্তিমানুষ কতগুলো পদক্ষেপ নিয়েছে দর্শনের ইতিহাসে । প্রথমত, চাহিদাকে শূন্য করতে পারলে কোনও অসম্পূর্ণতাকেই আর নিজের মধ্যেকার অভাব বলে মনে হবে না । জন্তুদের ভাষা নেই, তারা কি সেটাকে অভাব বলে মনে করে ? গাছেরা দৌড়তে পারে না, সেটা কি তাদের পক্ষে অসম্পূর্ণতা ? তারা তো কখনওই সেই চাহিদার অভাব নিয়ে প্রশ্ন তোলে না, বরং সেটাই তাদের পক্ষে স্বাভাবিক অবস্থান । তেমনই তুলনামূলকভাবে মানুষ তার বুদ্ধিমত্তার জোরে নিজেকে জীবজগতের সর্বোচ্চ স্তরে যেভাবে খুঁজে পেয়েছে, সেটাই তার নিজের পক্ষে সবচেয়ে সন্তোষজনক অবস্থান । এর বাইরে তার নিজের জন্য কোনও কিছুরই প্রয়োজন নেই । নিজের অস্তিত্বের অনুসন্ধানে প্রাথমিক কাজই হল নিজেকে চাহিদা শূন্য করা । চাহিদা শূন্য হলেই নিজেকে সম্পূর্ণভাবে খুঁজে পাওয়া যায়, এবং অসম্পূর্ণতার জন্য সবকিছুর বিরুদ্ধে লড়তে যাওয়ার আর কোনও প্রয়োজন পড়ে না, কারণ কোনও কিছুই আমার বাইরে নেই, সবকিছুই আছে আমার অভ্যন্তরে, যেখানে আমার আসল আমি, সবকিছু আছে তাকে ঘিরে । সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ জীবনকে চাহিদা শূন্য করার কথাই বলে । অর্থাৎ, জীবনের উদ্দেশ্যে মানুষ তাই করে যা করার উপাদান আগে থাকতে তার মধ্যে রাখা আছে । সার্ত্রে তাঁর শেষজীবনে এসে বলেছেন, 'আজ আমি কার বিরুদ্ধে কীসের বিরুদ্ধে লড়তে যাব, যখন কিনা আমার আর কোনওকিছুরই প্রয়োজন নেই ।' এই অনীহা, এই যে কিছুই না চাইবার অাস্থা, এবং কেউ কিছু ভালোবেসে স্নেহের সঙ্গে দিলে তা নিতে অস্বীকার করার অাত্মবিশ্বাস তখনই জন্ম নেয়, যদি নিজের গভীরে চাহিদাকে সম্পূর্ণরূপে নিঃশেষ করে ফেলা যায়, এবং নিজেকে বোঝানো যায় যে আমার আর কোনওকিছুরই প্রয়োজন নেই । কারণ প্রয়োজনগুলো যাকে ঘিরে, সেই আমি প্রয়োজনাতীতভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ । এই সম্পূর্ণতা অর্জন করা গেলেই নিজের ভিতরে সেই বিস্ময়কর শক্তির পরিচয় পাওয়া যাবে, যা চিরকাল প্রতিষ্ঠিত করেছে ব্যক্তিমানুষকে, তাঁর স্বতন্ত্র রক্ষার জন্য ।

এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছিন্নপত্রে কী লিখেছেন, সেই লেখাটুকু একটু তুলে দিই :

'অহমিকার প্রভাবেই যে নিজের কথা বলতে চাই তা নয় । যেটা যথার্থ চিন্তা করব, যথার্থ অনুভব করব, যথার্থ প্রাপ্ত হব, যথার্থরূপে তাকে প্রকাশ করে তোলাই তার স্বাভাবিক পরিণাম । ভিতরকার একটা শক্তি ক্রমাগতই সেই দিকে কাজ করছে । অথচ সে শক্তিটা যে আমারই তা মনে হয় না, সে একটা জগৎব্যাপ্ত শক্তি । নিজের কাজের মাঝখানে নিজের আয়ত্তের বহির্ভূত আর একটি পদার্থ এসে তারই স্বভাবমতো কাজ করে । সেই শক্তির হাতে আত্মসমর্পণ করাই জীবনের আনন্দ । সে যে কেবল প্রকাশ করায় তা নয়, সে অনুভব করায়, ভালোবাসায়; সেইজন্যে অনুভূতি নিজের কাছে প্রত্যেকবার নূতন ও বিস্ময়জনক ।'

(ছিন্নপত্র ১১৫, পৃষ্ঠা নং ১১২, ১৩ই অগস্ট ১৮৯৪, শিলাইদহ : বানান অপরিবর্তিত)

আরেকটি প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঐ ছিন্নপত্রেই লিখেছেন :

'আমাদের মধ্যে যা শ্রেষ্ঠ প্রকাশ সে আমরা কাউকে কেবল নিজের ইচ্ছা-অনুসারে দিতে পারি নে । সে আমাদের আয়ত্তের অতীত, তা আমাদের দানবিক্রয়ের ক্ষমতা নেই । মূল্য নিয়ে বিক্রি করতে চেষ্টা করলেই তার উপরকার আবরণটি কেবল পাওয়া যায়, আসল জিনিসটি হাত থেকে সরে যায় । নিজের যা সর্বোৎকৃষ্ট, কজনই বা তা নিজে ধরতে বা পৃথিবীতে রেখে যেতে পেরেছে; আমরা দৈবক্রমে প্রকাশিত হই, ইচ্ছে করলে, চেষ্টা করলে, প্রকাশিত হতে পারি নে । চব্বিশ ঘণ্টা যাদের কাছে থাকি তাদের কাছেও আপনাকে ব্যক্ত করা আমাদের সাধ্যের অতীত । কারো কারো এমন একটি অকৃত্রিম স্বভাব আছে যে, অন্যের ভিতরকার সত্যটিকে সে অত্যন্ত সহজেই টেনে নিতে পারে । সে তার নিজের গুণে । যদি কোনো লেখকের সবচেয়ে অন্তরের কথা তার চিঠিতে প্রকাশ পাচ্ছে তা হলে এই বুঝতে হবে যে, যাকে চিঠি লেখা হচ্ছে তারও একটি চিঠি লেখবার ক্ষমতা আছে ।'

(ছিন্নপত্র ১২৬, পৃষ্ঠা নং ১২১, ৭ই অক্টোবর ১৮৯৪, কলকাতা : বানান অপরিবর্তিত)

সুতরাং, প্রকৃত সত্যের সন্ধানে মানুষ ছুটে চলেছে সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে । চিত্রকর কিছুতেই তৃপ্ত হচ্ছেন না তাঁর প্রতিমুহূর্তে আঁকা চিত্রগুলোতে । লেখকের তৃষ্ণাও মিটছে না নতুন লেখাতে নিজের সর্বস্ব চিন্তাটুকু নিয়োগ করে । একইভাবে একজন দার্শনিক তাঁর সমস্ত তত্ত্ব প্রয়োগ করে জীবনের জটিলতা কাটানোর পরেও জীবনের অভ্যন্তরে থেকে যাচ্ছে অস্বচ্ছ ও অনাবিষ্কৃত দিক, প্রয়োজন পড়ছে পুরনো সময়ের তাৎপর্যগুলোকে পুনরায় অস্বীকার করা, এবং সৃষ্টির সমস্ত কোণের প্রসার কতদূর সত্য ও কতখানি ভূমিকাময়, তার ওপর আলো ফেলা, কারণ জানতে চাওয়া । দর্শনের ইতিহাস ও সৃষ্টি আজ এত বড় সামগ্রিকতাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে যেখানে সব বিষয়ের ব্যাখ্যাই দর্শনের অন্তর্ভূক্ত । বিশ্বব্যাপী সিভিল ওয়ার, আধুনিক পৃথিবীতে পুঁজিবাদের সমর্থন ও বিরোধিতা, মানুষের সমাজ-রাষ্ট্র-মননশীল কাঠামোগুলোকে নিয়ে দর্শন নিজেই আজ 'মডার্ন ইন্টেলেকচুয়াল স্টাডিজ'-এ পরিণত হয়েছে । তার মধ্যে বিচার্য হচ্ছে গণিতের নিয়মবলী ও সাহিত্যের কারণহীন সত্য বিশ্লেষণের জায়গা । লেখাপড়ার মৌলিকতা যে আসলে জীবনকে জানা ও তাকে নিয়ে আলোচনা করা, এবং নিজের ভিতরকার সত্যগুলোকে পৃথিবীর জন্য খরচ করা, তা সক্রেটিস আগেই বলে গিয়েছেন । আধুনিক মানুষ সে কথা বোঝার মতো বিবেক এখনও সংগ্রহ করে উঠতে পারেনি । আধুনিক মানুষ নব্যআধুনিকতার শিক্ষায় কেবল তৈরিই হয়েছে, উপযুক্ত হয়নি জীবনের ব্যাখ্যায় নিজেকে সংশয়ের জায়গা থেকে আলোর ধারণায় আনতে ।

 

(ক্রমশ চলবে)

 

 


1 comment:

  1. খুব ভালো তথ্যসমৃদ্ধ প্রাঞ্জল লেখা

    ReplyDelete