৭
হেমেন্দ্রকুমার দেওয়ানকে এখন চেনা যাচ্ছে না। অথচ সকালেই
যখন সেগুন গাছের চারাটি প্রতিষ্ঠা করল, তখন হেমেন্দ্রকুমারের ছিল অন্য রুপ। এখন
গম্ভীর। এতটাই চুপচাপ, গো – মহিষযানের চাকা ভেঙ্গে গেলে যান যেমন নির্বাক। দূরে
একটি বৃক্ষের দিকে তাকিয়ে গাছের ডালে বসে থাকা ঘুঘু পাখিকে হুশশশ করেই আবার
রাশভারী হয়ে গেল হেমেন্দ্রকুমার। পতিতপাবন চৌধুরী একটি কাগজের ওপরে ফর্দ লেখাতে
ব্যস্ত। জোড়া শিবমন্দির থেকে শুরু করে, সাপ্তাহিক হাটবেলার সমিতির কাজের হিসেবের
পাকা রক্ষক সে। ঘোষাল কর্তা বসে আছে ফরাসের একধারে। লবঙ্গ চিবোচ্ছে। আসার পথে
চৌধুরীদের জোড়া শিবমন্দির দর্শন করে এসেছে। চোখবুজে যন্ত্রসঙ্গীতের লহর স্মৃতি
থেকে শুনছে। মাথা দুলিয়ে যাচ্ছে। উপস্থিত কেউ কথা বললে উচ্চস্বরে কথা বললে, কপালে
বিরক্তির দাগ পড়ছে। হরেন ঘোষ আবার চঞ্চল। নীলকণ্ঠ চাটুজ্যের জন্য কেনই বা
প্রতীক্ষা। এসে যখন পড়বেই, শুরু করে দিলেই হয়। হেমেন্দ্রকুমার পিয়াদা বিশ্বনাথকে বলল,--
রেকাবিতে গজা, কাজু, ক্ষীরের সন্দেশ রাখা আছে নিয়ে আয়।
দিগম্বর, নিবারণ কেশবনন্দন জোড়া চাতালের এক পাশে। ফরাসের
এক কোণে। ইতিমধ্যে ফিটনের ঘোড়ার কণ্ঠ নূপুরের ছমছম শব্দ। নীলকণ্ঠ চাটুজ্যে এল।
হরেন ঘোষ হেমেন্দ্রকুমারকে বলল,-- তাহলে আর বিলম্ব কেন। বেশি দেরি হলে, আহ্নিকের
সময় পার হয়ে যাবে।
লালকণ্ঠ চাটুজ্যে ফিটন থেকে নেমে আজকের সভার চাতালে প্রবেশ
করেই, বলল,-- ঘর গড়ালে বুঝি ?
হেমেন্দ্রকুমারকে বলল,-- এই সবে। গেল শীতে।
যোধপুরের পাথর বসিয়েছ বুঝি ?
হ্যাঁ। বাগবাজারের খেয়া ঘাটে একদরে পেলাম। সুবিধা হল।
তা হলে বেলঘরে যোধপুরের লাল পাথর এল বলো ?
দেওয়ান বাড়ির চাতাল থেকে, নিবারণ ও দিগম্বর জনসন সাহেবের
তাঁবুটি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। তাঁবুর সামনে বসে টেবিলের ওপরে ঝুঁকে পড়ে সাহেব কি
যেন লিখছে। একটি ঘোড়া জনসন সাহেবের তাঁবুর একপাশে মন্থর ঘাস চিবিয়ে যাচ্ছে। ঘোড়া
!!! আবার কবে খরিদ করলেন সাহেব ? দিগম্বর অবাক হয়ে ভাবল। নিস্পলক তাকিয়ে চেষ্টা
করছিল, দেখে টুকে নেওয়ার চেষ্টা করছিল, আগের ঘোড়াটির সঙ্গে মিল পাচ্ছে কি না।
নিজের মনেই নিজেকে প্রশ্ন করল,-- কবে খরিদ করলেন ? সাহেব নিজের মনেই উত্তর
দিলেন,-- মুর্শিদাবাদ থেকে জমিদারের পিয়াদা পাঠালেন। জমিদার নিজের সেই সময় এবং এই
ঘোড়া উপহার দিয়ে, তোমাদের দেশে আমরা এসেছি, আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন।
দিগম্বর নিজের মনেই কথা বসিয়ে তারপরে মুখ আড়াল করে, ফিক করে হেসে দিল। একদিন বেলঘর
স্টেশন হবে। রেলগাড়ি দাঁড়াবে। সাহেব যেমন ছবি দেখিয়েছিলেন তেমন গাড়ি। ধুঁয়া
বাস্পের মুখ, সাহেব বলেছিলেন ইঞ্জিন। একদিন কেউ থাকবে না, রেলগাড়ি আসবে যাবে,
বিদ্যাধরী নদীর দিকে বয়ে যাবে, দেঁতের খাল। মানুষের খেয়াল কি বিচিত্র হয়... মনের ভিতরে মনের
কথা কি রহস্যময়।
হরিমোহন বসাক বলল,-- ভাবো তো সবাই একবার, কেশবনন্দনের আসার
কথা ছিল না কিন্তু ? ও কেন এল ? আমরা নিবারণ ও দিগম্বরকে আসতে বলেছিলাম।
কেশবনন্দন দিগম্বরকে ফিস ফিস করে বলল,-- যাতে কর্তারা
শুনতে না পায়, বাতাসা জলে ফেলে দিলে গুলে যায়, তেমন নম্র হয়ো না। কর্তারা পেয়ে বসবে।
আমাদের মাথায় নেত্য করবে।
দিগম্বর কেশবনন্দনের হাতে টোকা দিল,-- আস্তে বলো, শুনলে
কর্তাদের মাথায় রক্ত উঠে যাবে।
ঘোষাল কর্তা, সঙ্গীতের লহরের স্মৃতিতে বিভোর হয়ে আছে।
নূপুরের মতো জল বাজছে যেন। আহা !!! ভাবনার দৃশ্য যেন ছন্দ নিচ্ছে। সঙ্গীতের ওস্তাদ বসে আছে পালকির ভিতরে, পালকি
ফসলের মাঠের আল ভাঙ্গছে। জল ভরা মাঠ, পালকির সামনে ভাসছে মাছ। মাছটি সারেঙ্গির লহরের
শব্দের ছন্দে লাফাচ্ছে, পালকির সামনে রঙ্গিন দুইজন অশ্বারহী, একজন অশ্বারহীর কাঁধে
শকুন।
হরিমোহন বসাক আঙ্গুলের ডগা দিয়ে হাতের তালুতে একটি কাজুর
দানা টিপে হেমেন্দ্রকুমারকে বলল,- তল্লাটে উত্তম আলপনা কে দিতে পারে জানো ?
এখন এই প্রশ্ন কেন ?
ওস্তাদ আসছে। আলপনা ভর্তি উঠোনে বসে গান গাইবে।
দিগম্বর উচ্চস্বরে হাঃ হাঃ হাঃ করে উঠল।
হেমেন্দ্রকুমার বিরক্ত হয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করল,--
উহু...উহু... তাল কাটছ কেন ? রসিকতা কোরো না। এখানে আমার চাতাল কল্পনার জায়গা নয়।
এসো সবাই কথায় মন দাও। প্রথমে আমিই শুরু করি তা হলে, তোমরা কি দেখেছ ? পাকুড় গাছের
ডালে মেঘ ফেঁসেছে ?
পতিতপাবন চৌধুরী বলল,-- গাছের ডালে নয় মাথায়।
হরিমোহন বসাক বলল,-- ডালে নয়। গাছের মাথায়।
হেমেন্দ্রকুমার বলল,-- ওই হল ফাঁসল তো। কেউ আর মাঠে যাচ্ছে
না। তোমরা খেয়াল করেছ ? গাছের ডাল না মাথা তাই নিয়ে অযথা তর্ক করছ।
পতিতপাবন চৌধুরী বলল,-- ভাবো তো সবাই একবার, দেঁতের খালের
ধারে সাদা চাদর শরীরে চাপিয়ে অপেক্ষা করছে লাঙ্গলের কারিগর সত্যসাধনের জন্য। কতবার
করে, সংবাদ পাঠিয়ে খবর দিলাম, খুঁজে বার করে, দাহ করে দিক। যদি লাশ পচে গিয়ে থাকে,
তাহলে, নুন চাপা দিলে এই সর্বনাশ হত না।
লালকণ্ঠ চাটুজ্যে বলল,-- এখন ওদের ঘাড়ে ভর করে তল্লাটকে
দোষ করছে। গ্রামজীবনের পক্ষে এ ভয়ানক। একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
হরিমোহন বসাক বলল,-- এ আধিভৌতিক বিষয়। তান্ত্রিক ডেকে সামাধান
না করলেই নয়।
নীলকণ্ঠ চাটুজ্যে ফতুয়ার সোনার বোতামটি খুঁটে খুঁটে বলল,--
সতুর বৌ শুকনাকে দেখা গেছে নিবারণের সাথে। ও দেঁতের খালের পাড়ে পড়েছিল। আমাদের
ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলিকে আগে সব জানাতে হবে। না হলে ওরা পার পেয়ে যাবে। এই সব
লাঙ্গলের ফড়ের কাজ। সাধারণ লাঙ্গলের কারিগর এদের পিতা সত্যসাধন গ্রামে গ্রামে
ভুতের কাজকম্ম করছে। আর এখন নিবারণের ঘাড়ে ভর করেছে।
নিবারণ সব শুনছিল। দিগম্বরের চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে। ওরা বুঝতে পারছে, নিজের মতো করে লাঙ্গলের
কাজ করে, কৃষি সরঞ্জাম গ্রামবাসীদের তৈয়ার করে দিয়ে মাতব্বরদের থেকেও তাদের
গ্রামবাসীরা অধিক মান্য করে, মাতব্বররা তা মেনে নেবে কেন ? চারদিকের তল্লাটে,
নিবারণের হাতেই তৈয়ার করা, সব সরঞ্জাম মাটিকে কর্ষণ করেছে। মাতব্বররা জেনে গেছে,
নিবারণ ছাড়া এই তল্লাটে লাঙ্গলের কোনো উপায় নাই। নিবারণ নিজেকে আক্রমণাত্মক না করে
তুললে, ওরা যে পেয়ে বসবে, সেটা নিবারণ জানে। কীসের তলব ?
নিবারণ নিজের কণ্ঠকে যতটা পারল দৃঢ় করে, বলল-- আগে
ব্যাখ্যা করুন তলব হকুম আদেশ এই নির্দেশগুলির।
লালকণ্ঠ চাটুজ্যে বলল,-- কি বলতে চাইছ ?
যা আপনাদের বললাম, তাই বলতে চাইছি।
হেমেন্দ্রকুমার বলল,-- ব্যাখ্যা কেন চাইলে নিবারণ ? আমরা
যা কিছু বলি সেটিই বিধান। এটিই মুখুজ্জে চাটুজ্যে বসাক ঘোষ চৌধুরীদের নিয়ম। বলতে
পারো সেনের আড়া পারবাসুদেবপুর বেলঘরের নিয়ম।
সে আপনাদের নিজেদের মতো খেয়াল। সব মতোই যে সব মতোর নয়।
আপনাদের মতো আমার নয় তাই ব্যাখ্যা জানতে চাইলুম।
হরিমোহন বসাক বলল,-- বিহিত চাই এই ঔদ্ধত্বের।
লালকণ্ঠ চাটুজ্যে বলল,-- অতিবৃষ্টি প্লাবন গবাদি পশুর মড়ক,
পাকুড় গাছের মাথায় মেঘ জড়াল এইসবের অর্থ কি দেওয়ান বড়ঠাকুর, বলেন তো ? মাঠে
নিবারণের ভয়ে কেউ কাজে যাচ্ছে না। পাছে যদি ঘাড়ে চেপে বসে, এক ছিল সত্যসাধন আর এখন
নিবারণ। ওহে নিবারণ তুমি এখনও সত্যসাধনের প্রেতকে ধাওয়া করে চলেছ কেন, এ যে ভারি
অনাচার।
নিবারণ বলল,-- আমার পিতৃদেবের আহ্বানকে আপনারা ধাওয়া বলছেন
কেন ? আমাকে তিনি অনুসরণ করতে বলেন। তিনি তাঁর লাঙ্গলবাবার বিদ্যাকে অনুসরণ করতে
বলেন। আমি তাই করি।
হরিমোহন বসাক বলল,-- তা হলে গ্রামে এই তল্লাটে ভূত ভূত
খেলা করছ, এর ব্যাখ্যা দিতে হবে।
দিগম্বর বলল,-- কার ব্যাখ্যা করব ? কীসের ব্যাখ্যা করব
আমরা ? এই ভুবনের আলো বাতাসের কোনো ব্যাখ্যা হয় না। আমদের পিতৃদেব, আলো ছায়া হয়ে
ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তিনিই অনুসরণ করতে বলছেন। খোলা মাঠের বাতাস আলো যদি আপনাদের
অনুসরণ করতে বলে, আপনেরা কি করবেন ? আমাদের পিতৃদেব এখন আমাদের কাছে অতীত। তিনি
আমাদের কাছে এখন কল্পনা।
লালকণ্ঠ চাটুজ্যে চিৎকার করে উঠল...এতটাই জোরে,
হেমেন্দ্রকুমারের চাতালের যোধপুরের লাল পাথর কেঁপে উঠল। এতটাই উঁচুতে সেই শব্দ,
জনসন সাহেবের নতুন খরিদ করা ঘোড়াটি ঘাস চিবিয়ে হেমেন্দ্রকুমারের চাতালের দিকে মুখ
তুলে তাকাল।
পতিতপাবন চৌধুরী এতক্ষণ সবার কথোপকথন শুনছিল। ঘাড় তুলে
বলল,-- সত্যসাধনের কয়টি সন্তান।
নিবারণ বলল,-- এই প্রশ্নের উত্তর আমাকে জিজ্ঞাসা করুন পতিত
কাকা। এমনিতে তার লাঙ্গলবাবা ছিল, মই আগড় ছিল। পশুযানের চাকা ছিল। আলো বাতাস বৃক্ষ
ফসলের মাঠের আল – কিন্তু বাস্তবে তার মাত্র দুইটি সন্তানই আপনাদের সামনে উপস্থিত। আমি
এবং আমার অনুজ দিগম্বর। আর আমাদের দুইজনের আপন সুহৃদ কেশবনন্দন আপনাদের তলব বলব
না, আহবানে উপস্থিত। আমার পিতৃদেব এই চলমান জগতের বায়ু ছিলেন, আমাদের চাষকর্মের
দেবতা ছিলেন। তিনিই একমাত্র এই তল্লাটের লাঙ্গলবাবার বিদ্যা অর্জন করেছিলেন। আমি
তাকে শুধুমাত্র অনুসরণ করে চলেছি। আপনারা আমাকে গাছের মাথায় দেখেন। দেঁতের খালের
পাড়ে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে থাকতে দেখেন, সে সবই সত্য। মিথ্যা নয়। আমার ভক্তি আছে তাই,
পিতৃদেবের কল্পনায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকি।
হেমেন্দ্রকুমার বলল,-- আমার মন্দিরের চাতালে বসে এ কি
তোমার ম্লেচ্ছগিরি নিবারণ ?
দিগম্বর বলল,-- একটি সত্যকে আপনারা সবাই মিথ্যে হিসেবে
প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। আপনারা কি কেউ আপনাদের পূর্বপুরুষদের এখানে উপস্থিত করতে
পারবেন ? পারবেন তাদের স্মৃতিকে উপস্থিত করতে ? ওই দেখুন জনসন সাহেব যিনি আমার
অত্যন্ত সম্মানীয় প্রিয়ভাজন, শ্রদ্ধেয়ভাজন তার ঘোড়াটি তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে ঘাস
চিবোচ্ছে, দেখুন মাঠে এখনও প্লাবনের চিহ্ন, ধানমাঠে মাঠকাদার দাগ এখনও এলোমেলো।
গাঁয়ের সজারু ডিঙ্গি, বিলের কচ্ছপ, গলসে পুঁটি এই সবই, আমার পিতৃদেবের ছায়ার মতো
সত্য। এ তল্লাটের আপনেরা মাতব্বর, রক্ষাকর্তা বলব না কারণ তিনি আর যাই হোন মানুষের
বিশ্বাস আর নিয়তির বিচার করেন না। আমরা আমাদের মানব জীবনে সবাই পূর্বপুরুষদের
বিভিন্নভাবে দেখি। আপনেরাও দেখেন। আমার জ্যেষ্ঠ নিবারণ সেও দেখেছে তার মতো করে। যে
যার মতো করে দেখে। কিন্তু তার দেখার বিচার হবে কেন ? পিয়াদা পাঠিয়ে আমাদের তলব
করবেন কেন ? আপনাদের তলব ও বিচারসভাকে মন থেকে অনুমোদন করি না। আমাকে কাল সকালে
বেইলি সাহেবের কাছারিতে চলে যেতে হবে। সেইখানে আমি মানচিত্র আঁকার কাজ করি, আপনেরা
জানেন। সাহেবের কাছারিখানাতে একবার প্রবেশ করলে, বাড়িতে ফেরা হয় না। আমাদের ফিরতে
হবে। অন্ধকারে খড় কেউটের ভয় আছে। সাথে করে লন্ঠনও আনিনি।
শিবমন্দিরের বাঁধানো চাতালে তাজা বেলপাতার টুকরো চাটছিল
শুঁয়োপোকা। বিকেলে চরাচরের নরম আলো মরে আসছিল। শিবলিঙ্গের পাথর বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে
প্রভাতের নিবেদিত দুধ। শুকিয়ে যাওয়া দুধের দাগের ওপরে কুৎসিত আলপনা হয়ে বসে আছে
মাকড়শা। বিকেলের শেষ আলোতে বুড়ো নিমগাছের মাথায় যে ভাবে ডানা ঝাপটে বাদুর চঞ্চল
হয়ে ওঠে। অন্ধকার নেমে এলেই ফলের অভিযান। বহুদূরের ভিন গাঁয়ের পশুযান ফিরে যাচ্ছে
আড়িয়াদহের নদীর পাড় থেকে মাটি নিয়ে, প্রতিমা গড়ার কাজ হবে। খোলা মাঠে রেলকুলিরা
রান্নার আয়োজন করছে। বিকেলের মরা আলোতে আগুনের রঙ উজ্জ্বল হয়। কাঠকুটো ডালপোড়া
গন্ধ জট পাকাচ্ছে। জনসন সাহেব টেবিলের ওপরে ঝুঁকে পড়ে এখনও কি যেন লিখে যাচ্ছে।
তাঁবুর মাথার ওপরে লম্বা লগার মাথায় একটি ফেচ্চু পতঙ্গ ধরবে বলে, লেজের ডগা
ক্রমাগত কাঁপিয়ে যাচ্ছিল। হেমেন্দ্রকুমার বিশ্বনাথ পিয়াদাকে বলল,-- যা রসুলকে ডেকে নিয়ে আয়।
রসুল লালকণ্ঠ চাটুজ্যের ফিটনের পাদানিতে বসে বসে পা
দোলাচ্ছিল। আর ঘোড়াদুইটির শরীরে গামছার ঝাপটা দিচ্ছিল। নীলকণ্ঠ চাটুজ্যের ঘোড়া
দুইটির পালিস করা শরীর দেখে হেমেন্দ্রকুমারের ঘোড়া দুইটিকে মেলাতে চেষ্টা করছিল। বিশ্বনাথ যখন সংবাদ দিল, রসুল তখন
ঘোড়ার মধ্যেই ডুবে ছিল।
রসুল নিজের আত্মমগ্নতা কাটিয়ে উঠে দাঁড়াল। কি করে বুঝবে,
হঠাৎ করে কেন হুজুরের তলব। তা ছাড়া মন্দিরের চাতালে তার প্রবেশের অবাধ অধিকার নেই।
কখনো কখনো হুকুম হলে। গোবেচারা নিরীহ হরিণ যেন। যে ভাবে হুকুমের তাগিদে খেদিয়ে এ
পাশে এনে দিলে। রসুল ভোলা নগেন তাই এইদিকে বড় একটা থাকে না। আসেও না। সভা শুরুর
আগে, বাবুদের নানান ফাই ফরমায়েশের উপদানগুলি হাজির করে দেয়।
রসুল কি করে বুঝবে হুজুরের কেন তলব ? এইখানে থেকে থেকে সে
বুঝতে পেরছে অধিকাংশ সময়ে তলবের যথাযথ কারণ। হঠাৎ এই সময়ে সে একটু অবাক হয়ে গেল।
কেশবনন্দন হাঁটু মুড়ে উবু হয়ে বসে বলল,-- ওনারা তো দূরের
কথা, আমিই দেখি নাই।
হেমেন্দ্রকুমার রসুলকে দেখে যেন ভরসা পেল,-- তুই যা
দেখেছিস, যা পেয়েছিস তাই বলবি, তল্লাটের ভালোর জন্য বলবি। সবার ভালোর জন্য বলবি।
তুই তাকে দেখেছিস। তোকে যে গাছপাকা কাঁঠাল দিয়েছিল তার কথা বলবি। কর্তাদের সত্যি
কথাটিই বলবি। কর্তাদের বলে দে।
নিবারণ, দিগম্বর ও কেশবনন্দনকে রসুল একবার দেখে নিল। ওদের
তিনজনের মধ্যে যে দূরত্ব দূরত্বটি ফল ফলাদি মাসের একটি সুমিষ্ট সেতু। আব্বুর আমলের
ফলের মাস যেন বিচার সভায় উপস্থিত হয়ে, অনেক তেঁতো হয়ে গেল। আজকে সকাল থকে দুপুর
পর্যন্ত কর্তা হুজুর যাদের সঙ্গে বৃক্ষ প্রতিষ্ঠা করল, তাদেরই ডেকে এনেছে বিচার
সভায়। এ বড়ই অদ্ভুত। বিচার হয় তো এমনই হয়।
নেই। পতিতপাবন ঘোষাল মাথা দুলিয়েই চলেছে। সারেঙ্গি বেজেই
চলেছে, সংগীত তার অন্তরের কোঠায় সবসময় তরঙ্গ তোলে। সে কোনই কথা বলছে না। হলেই বা
সে কর্তা বা মাতব্বর, সে এসেছে সভায় সখ্যের কারণে। কিন্তু সভার কোনো কাজে বা, কোনো
কথায় তার মন নেই। সে সারাদিন ধানমাঠ দেখে, আর নিজের ভিতরে সঙ্গীতের তরঙ্গ দুলিয়ে
চলে।
হেমেন্দ্রকুমার বলল,-- চুপ করে আছিস কেন ? কে দিয়েছিল তোকে
?
রসুল চুপ। নিবারণ, দিগম্বর কেশবনন্দনের দিকে তাকিয়ে থেকে
ভিতরের কথাগুলি তার জলের দাগ হয়ে গেল। হুজুরের কথার সে কি উত্তর দেবে ? মন্দিরের
চাতালের ওপরে, দেওয়ালে রেখার দাগ এখন মলিন হয়ে এল। চারধারের আলো ঝিমিয়ে আসছে।
কে দিয়েছিল তোকে বলছিস না কেন ?
আমাকে গাছের ডাল দিয়েছিল, আপনাকে আমি আগেই বলেছিলাম।
হেঁয়ালি করছিস কেন ? সত্যি কথাটি বলছিস না কেন ?
আজ্ঞে। আপনাকে বলেছিলাম।
সত্যি কথা বলছিস না কেন রসুল ?
সত্যিই বলছি।
তোকে দেয়নি ? নিজেই বলেছিলি না ?
যা সত্যি তাই বললাম।
তুই সত্যসাধনের কথা বলেছিলি।
সত্যসাধন কর্তা আমার সম্মানীয়। তার সম্পর্কে আমি কিছু
বলিনি। আমি বলেছিলাম একটি গাছের ডালের কথা। গাছের ডাল কেন সত্যসাধন কর্তা হতে যাবে
বাবু ?
তুই সত্যি কথা বলছিস না ? তোর মতো অনেকেই দেখেছে,
সত্যসাধনকে তল্লাটে। মৃত্যুর পরে কাউকেই দেখাই যে গ্রাম তল্লাটের পক্ষে ভালো নয়
রসুল ?
নিবারণ বলল,-- আমি বলছি আপনাদের বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি
বলছি তো আমি তার, আমার পিতৃদেবের অনুসরণ দেখেছি। আমি তার যাওয়া দেখি আমার কল্পনার
মধ্যে। আমি তাকে অনুসরণ করে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যাই।
তুমি থামো নিবারণ।
যা সত্য তাই বললাম কর্তা।
হেমেন্দ্রকুমারের বায়ু মাথায় উঠে গেল। বলছে কি ? সামান্য
লাঙ্গলের মিস্ত্রি ? কে হে কারিগর তুমি ? গোটা গ্রাম তল্লাটে আধিভৌতিক সর্বনাশ
ডেকে এনেছে। মাঠকর্মী মাঠের কামলারা কি ভাবে কাজ করবে ? যদি এই ভাবে সত্যসাধনের
প্রেত মাঠে মাঠে বিচরণ করে বেড়ায় তা হলে চাষকর্মের কাজ চলবে কি করে ? গ্রামের মাঠে
মাঠ তৈয়ারির কাজ থেমে যাবে। সর্বনাশ হয়ে যাবে। ফসলের মাঠ অনাবাদি হয়ে যাবে।
নিবারণ এবার উচ্চস্বরে বলল,-- দেওয়ান কর্তা, আমি আমার
পিতৃদেবের প্রেত দেখি নাই। শুধু তাকে অনুসরণ করে জানতে চেয়েছি আরও গভীরতর
লাঙ্গলবাবার বিদ্যার রহস্য।
হেমেন্দ্রকুমার বুঝতে পারছিল, রসুল তার ঔদ্ধত্যের অহ্নকারে
হাত দিয়েছে। পাশাপাশি সব কর্তা যেন গুমরোচ্ছে। হেমেন্দ্রকুমার যেন কাউকেই কথা বলতে
দিচ্ছে না। বলল,-- এতবড় একটা সত্যিকে তুই মিথ্যে বললি রসুল ? কর্তারা একটা
সিদ্ধান্তে আসতে চাইছিল, গ্রামের ভালোর জন্য, তুই সব মিথ্যে করে দিলি।
হেমেন্দ্রকুমার তার পায়ের চপ্পলটি ছুঁড়ে মারল রসুলকে। রসুল দেওয়ানকর্তার চপ্পল
তুলে নিয়ে মাথায় ঠেকাল। আব্বু ইন্তেকালের আগে দেওয়ানকর্তার কাছে সমর্পণ করে দিয়ে
বলেছিল, দেখবেন কত্তা। আপনি আমার খোদা।
রসুলের চোখ ছলছল করে উঠল, সে আঁধারে ঢাকা দেওয়ান বাড়ির
সিংহদুয়ারের দিকে নিস্পলক তাকিয়ে ছিল। দেওয়ান বাড়ি থেকে পথ চলে গেছে ফতুল্লাপুরের
তার আব্বুর কবরখানার দিকে। নিবারণ কাকার হাতে তৈয়ার করা কাঠের কফনে। কত ভালোবাসার
স্পর্শ আছে নিবারণ কাকার। রসুল তাকিয়ে ছিল, মান্যিগণ্যদের মুখের দিকে।
লালকণ্ঠ চাটুজ্যে উচ্চস্বরে বিশ্বনাথকে হুকুম করল,-- ওদের
ডেকে নিয়ে আয়।
কাদের হুজুর ?
সেদিন যারা মাঠে ছিল।
আজ্ঞে, মাফ করবেন হুজুর। বুঝে উঠতে বিলম্ব হচ্ছে।
গাছের মাথায় যেদিন মেঘ ফেঁসে গেল, তারপরে দিন রাত্রি হয়ে
গেল, মনে হল যেন সূর্য পূর্ণগ্রাস।
বিশ্বানাথ পিয়াদা বলল,-- আমি তো সেদিন মাঠেই ছিলাম না
হুজুর ? ক্রতাবাবু আমাকে আড়িয়াদহে অন্য কাজে পাঠালেন।
রসুল হেমেন্দ্রকুমারের চপ্পলটি যথাস্থানে রেখে বলল,-- আমি
সেদিন মাঠে ছিলাম হুজুর। আমি জানি কে কে ছিল। গাছের ওপরে মেঘ আটকে গেছে দেখে, আমরা
সবাই উল্লাসে নেচে উথেছিলাম।
নিবারণ ও দিগম্বর বুঝতে পারছিল সভার কাজ ও পরস্পরের কথা
কাল্পনিক হয়ে উঠছে। মাতব্বররা নিজেদের মতো করে, কথা সাজিয়ে নিতে চাইছে। ফিস ফিস
করে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল। চারদিকের আলো মরে গেলেও কেমন যেন উজ্জ্বলতার
পালিসের রেস রেখে গেছে। সেই আলোর পালিস হয় তো রসুলের পক্ষ নিয়েছে। চাতালের পাশে
শুকনো পাতার স্তুপ থেকে আদ্র মাটির গন্ধ উসকে আসছে।
কেশবনন্দন বলল,-- লাঙ্গল বানানোর সুখ্যাতির দাম দিতে হচ্ছে
গো নিবারণদা। বেইলি সাহেবের কাছারিখানায় মানচিত্র আঁকার কাজের দাম তোমাকেও দিতে
হচ্ছে দিগম্বর। সকালে তোমরা একসাথে বৃক্ষ রোপণ করলে, আর এখন দেওয়ান কর্তার রূপ
দেখ। এরা ক্ষমতাধারী। বুঝে ওঠা খুব মুশকিল।
নিবারণ বলল,-- রসুল গেল যে ?
যাদের ডাকতে গেছে, ওদের মাপ রসুলের মতোই।
নিবারণ ভয়ে ভয়ে বলল,-- অতীত এখন কল্পনার আশ্রয়ে কেশবনন্দন।
বর্তমান এখন মিথ্যার আশ্রয় চাইছে। ভবিষ্যতে কি ঘটবে জানব কি করে ? আমার অনুসরণকে
বিভ্রম করতে চাইছে।
যত জনকে পারল ডেকে আনল রসুল। আট দশজন হবে। নারু, কেতো, গোলামুদ্দিন,
চৈতন্য, ভবনাথ, নিমু, গোবিন্দ...বিভিন্ন পেশার। কেউ গবাদি পশু চড়ায়। কেউ চাষ করে।
কেউ দিনমজুর। কেউ পাখুয়া, ঘুরে ঘুরে আবার কেউ লতাপাতা ভেষজ সংগ্রহ করে কবিরাজকে
যোগান দেয়।
একখান নয়, দুইখান নয়, তল্লাটের সকল মাতব্বর ডাক দিয়েছে। আজ
কি ওদের সৌভাগ্য। এমনি দিনে কর্তারা ফিরেও তাকায় না। সন্ধ্যাতারা ভেসে উঠেছে, সব
স্পর্শের বাইরে হলেও যেন উজ্জ্বল আলো বলে দিচ্ছে আমাকে স্পর্শ করো... স্পর্শ করো। দুই
হাতকে বুকের মধ্যিখানে রেখে,- আজ্ঞে আপনেদের মহাকৃপা।
হরিমোহন বলল,-- তল্লাটের ভালোর জন্য তোদের ডেকে এনেছি।
সেদিন, সেই প্রবল বৃষ্টির আগে, তোরা মাঠের কাজ করতে করতে, গাছের মাথায় মাথায় দেখলি
মেঘ ফেঁসে গেল।
মাতব্বর, কর্তারা সবাই একসাথে বলল,-- মেঘ ফেঁসে গেল !!!
লালকণ্ঠ বলল,-- আর কি কি দেখেছিলি ?
নারু বলল,-- সজারু।
কেতো বলল,-- ডিঙ্গি দেখেছিলাম কর্তা।
গোবিন্দ বলল,-- ধনেশ পাখি দেখেছিলাম।
গোলামুদ্দিন বলল,-- বনবিড়ালের মতো।
সবাই নিজেদের মতো করে কথাগুলিকে গুছিয়ে নিয়ে সমস্বরে বলতে
থাকল পরের পর...
সজারু
ডিঙ্গি
ধনেশ পাখি
ফিঙে
বাতাসে ভেসে যাওয়া খোলা ছাতা
মাছ লাফাচ্ছিল।
পরেশ বাউল গান গেয়ে হাত পেতে মেঘের কাছে নদী চাইছিল।
মনোরঞ্জন বাগদি খাল বিল চাইছিল।
হেমেন্দ্রকুমার, লালকণ্ঠ, হরিমোহন একসাথে চিৎকার করে
উঠল,-- আর কিছুই দেখিস নি ?
ওরা চুপ।
হেমেন্দ্রকুমার বলল,--
লাঙ্গলের কারিগর সত্যসাধনকে ?
গোবিন্দ বলল,-- তিনি তো মারা গেছেন কর্তা বাবু ?
লালকণ্ঠ বলল,-- হ্যাঁ... হ্যাঁ... তার প্রেত।
হেমেন্দ্রকুমার বলল,-- নিবারণকে দেখিস নি ? পড়ে ছিল দেঁতের
খালের পাশে ?
হরিমোহন বলল,-- ছিঃ। ছিঃ। পাশে সতুর বিধবা বৌ শুকনা ছিল না
পাশে ?
চৈতন্য বলল,-- না কর্তাবাবু আমরা এইসব কিছুই দেখি নাই।
কিছুক্ষণ পরে গোটাকয়েক লন্ঠনকে আঁধারে ভেসে থাকতে দেখা
গেল। গভীর অন্ধকারে যেমন আলো হাঁটে। মন্দিরের পাশেই দানবাকৃতির তেঁতুল গাছটি থেকে
বাদুরগুলি উড়ে যেতে থাকল গাছের ডাল ছেড়ে। আর কুৎসিত প্রতিধ্বনিত চিৎকার, কর্কশ,
কানে চিন চিন করছিল। জনসন সাহেবের তাঁবুর ভিতর থেকে, ল্যাম্পের আলো চাতাল পর্যন্ত
টিপ টিপ করছিল। আঁধার সত্য, আলো সত্য, নামে ওঠে প্রতিদিন। দিনের আলোতে চঞ্চল জনপদ।
পঞ্চি হয়ে উড়ে যায় খুশির আকাশে, আলোর উৎসে মাঠে মাঠে মানুষ স্বাধীনতা পায় –
হিল্লোরি... হিল্লোরি... হিল্লোরি...। আঁধারে গ্রাম তল্লাটকে আদিম মনে হয়। ঝি ঝি
পোকার ডাক খা খা করে। তিন প্রহর ধরে শেয়ালের ডাক আবার কখনো কখনো বহুদূর থেকে
কল্পনায় শোনা যায় বাঘের ডাকের মতো শব্দ। নাড়িকুড়ি আদিবাসী গ্রামের দিক থেকে গভীর
রাত্রি পর্যন্ত দ্রিম দ্রিম শব্দ।
নিবারণ গভীর আঁধারের দিকে নিস্পলক তাকিয়ে ছিল। চরাচর জুড়ে,
মানব অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে থাকলেও, আলোর সঙ্গে আঁধারও জড়িয়ে থাকে। চাতালের ওপরে
এখন আর কোনোই কথোপকথন নেই।
পতিতপাবন ঘোষাল মাথা দুলিয়েই চলেছে। সারেঙ্গি বেজেই চলেছে,
সংগীত তার অন্তরের কোঠায় সবসময় তরঙ্গ তোলে। আধারেরও এক প্রকার তরঙ্গ আছে, সে চোখ
বুজে আজকের সমস্ত আলোচনাকে উপেক্ষা করে নিজের গভীরে সঙ্গীতের তরঙ্গের সঙ্গে সহবাস
করছে যেন।
কর্তা হুজুর মাতব্বর সবাই ভেঙ্গে যাওয়া পুতুলের মতো, পড়ে
আছে। রসুল যাদের ডেকে এনেছিল, তারা একে একে সবাই চলে গেছে। রসুল চলে গেল, ছায়ার
মতো সিংহদুয়ার অতিক্রম করে। হেমেন্দ্রকুমার এলিয়ে আছে তাকিয়ার ওপরে, রসুলের চলে
যাওয়া দেওয়ান বাড়িকে, আর ফিরে না আসার ইঙ্গিত দিয়ে গেল।
দিগম্বর নিজের কণ্ঠকে যতটা পারল বিনম্র করে বলতে থাকল, ...
কোনো ধারণাই চিরকাল একরকম থাকে না। সব ধারণাই রূপান্তর হয়ে একসময় হারিয়ে যায়। আবার
নতুন ধারণা আসে, আবার তা পুরাতন হয়। আমাদের পিতৃদেব স্বর্গীয় সত্যসাধন মণ্ডল তিনি
তাঁর লাঙ্গলবিদ্য আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা নিবারণ মণ্ডলকে প্রদান করেছেন। সে আমাদের
গ্রামসমাজে এই বিদ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। কখনো কখনো সে কল্পনায় মাঠে ঘাটে
পিতৃদেবকে দেখতে পায়। সে মনে করে পিতৃদেব তাকে আহ্বান করছেন, সেই আহ্বানে সাড়া
দিয়ে তাঁকে অনুসরণ করে। নিবারণ মণ্ডল আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতার এই প্রকার আচরণের মধ্যে
আছে শ্রদ্ধা ও লাঙ্গল তৈয়ারির কাজে একাত্মতা। এইটি তার নিজের হৃদয়ের অনুভূতি। এই
আবেগ বা চেতনার পাণ্ডিত্য যুক্তি নেই। আবার বিশেষ সভা আহ্বান করে এই আবেগ অনুভূতির
বিচারও হয় না। তা ছাড়া আমরা দুই ভ্রাতা আমাদের পিতৃদেব দ্বারা প্রণীত পুঁথির
পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করতে পারি নাই। তক্তপোষের নিচে কাঠের তোরঙ্গের ভিতরে ছিল। সেই তোরঙ্গের ছিদ্র অনুসন্ধান করে উইপোকা সমস্ত
পাণ্ডুলিপির সর্বনাশ করেছে। সেই অনুশোচনায় আমাদের দিবারাত্রি একাকার। আপনাদের বিশ্বাস গাছে গাছে মাঠে মাঠে আমার
পিতৃদেবের সত্যসাধন মণ্ডলের প্রেত বিচরণ করে, গ্রামের স্বাভাবিক কাজকর্মে বাঁধা
দিচ্ছে। গ্রামের অমঙ্গল ডেকে আনছে। কিন্তু তা কি সত্য ? এই ভাসা ভাসা বাতাসের মতো
অভিযোগ বেইলি সাহেব এবং জনসন সাহেব ও ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্থানীয় ভারপ্রাপ্ত
সচিব উইদেনস্টাইন সাহেব শুনলে অট্টহাসি হাসবেন। আমি জানি বৃক্ষের মাথায় মাথায়
মেঘের আগমন, যেন মহাকালের অতি বৃষ্টি ও প্লাবন এই সমস্ত কিছুই প্রকৃতির খেয়াল। এতে
আমার পিতৃদেবের কোনই হাত নাই। কিন্তু গ্রামজীবনের বিপন্নতার জন্য কাউকে চিহ্নিত
করাই আপনাদের উদ্দেশ্য। হুজুর এই রাত আজকের কৃষপক্ষের রাত, চাঁদের অস্তিত্ব
সামান্যই, শুধুমাত্র একটি ক্ষীণ রেখা, এই রাত যদি আর না ফুরোয়,- তবে এই রাত থেকে
যাবে অনন্তকাল, যেমন খেয়ালে দিন ও রাত্রি, গাছের মাথায় মাথায় যেমন মেঘ – মিথ্যে
নয় হুজুর, আসুন এই খেয়ালের কাছে নত হই। মাথা নত করি। এই খেয়ালের সামনে, আমরা
মানব্জাতি সামান্য... সামান্য...
হেমেন্দ্রকুমার দেওয়ান বলল, -- আমাদের ইচ্ছা তোমরা তোমার
পিতৃদেবের আত্মার প্রতি প্রায়শ্চিত্ত করে,
বেলঘর ছেড়ে চলে যাও। ফিঙ্গের ওইদিকে আমার কিছু জমি আছে, ফসল সমৃদ্ধ চারবিঘা
কুটিরসহ, তোমরা ওইখানে গিয়ে বসবাস করো।
তার মানে হুজুর আমরা আমদের শিকড় ছিন্ন করে আমাদের বসবাস
তুলে নিয়ে ফিঙে চলে যাব। আমরা বেলঘর থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাব।
তোমরা এইখান থেকে চলে গেলে, তোমাদের পিতৃদেব এই গ্রাম ছেড়ে
চলে যাবে।
আমার পিতৃদেব এখন
আর বর্তমান নয় হুজুর। কিন্তু ... কিন্তু...
যা বললাম সেইটাই আমাদের সিদ্ধান্ত। এই সভার সিদ্ধান্ত।
জমির পরিমাণ, ও অঞ্চল ভূমিদেবতার পূর্বনির্ধারিত। এর কোনো
নিয়তি নাই। সুতরাং আপনাদের আধিভৌতিক ধারণার ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিচারের শিকার
আমরা। আমি আপনাকে উদ্দেশ্য করে বলছি না। কিন্তু আজ বিচারসভার মধ্য দিয়ে অনেকের
সর্বনাশ যেন উঁকি দিয়ে যাচ্ছে।
হুজুর মাতব্বর একে একে কর্তারা সবাই তন্দ্রাচ্ছন্ন। যেন
জমি দখলের আফিমের নেশায় ঝিমোচ্ছে। ধুলাখেঁদি খোকনের ঘুড়ি সুতো ছিঁড়ে বগ্গা খেয়ে যেখানে
পড়বে, সেটাই কর্তা হুজুর আর মাতব্বারদের জমি। মাঝে শুধু দ্বীপের মতো টিম টিম সত্যসাধনের
কুটির ফসলের জমি গোয়ালমন্দির আর লাঙ্গল তৈয়ারের উঠান। নিবারণ, দিগম্বর, কেশবনন্দন
মন্দিরের চাতাল থেকে নেমে গিয়ে, বেলঘর গঞ্জের পথে নেমে গেল।
পতিতপাবন ঘোষাল দ্রুত হেঁটে, ওদের অনুসরণ করল। আর ডাকছিল,
দিগম্বর... দিগম্বর।
ওরা তিনজন চমকে উঠল।
পতিতপাবন বলল,-- বেনারস থেকে ওস্তাদ এসেছে। সুতানুটিতে
অনেকগুলো আসর করেছে। ওস্তাদ না কি বেলঘরে এসে গেছে। দেওয়ান বাড়িতে আসর বসবে। আমি
যেহেতু আজকের সভায় কোনো কথা বলি নি, তাই আসর বসলে আমাকে সংবাদ দিও।
নিবারণের এই কথার অন্য উত্তর হতে পারত, কিন্তু সে পতিতপাবন
ঘোষালকে বলল,-- আপনে কালকে একবার আমার প্রাঙ্গণে আসবেন। আপনারে একটা ভগভগি উপহার
দেব।
দারুণ লেখা। আপনার সব ধরনের লেখালেখিরই ভক্ত আমি।
ReplyDelete