মেকওভার
তিন মাস হল অনির্বাণের বিয়ে হয়েছে। রিসেপশন ছিল ওদের কৃষ্ণনগরের বাড়িতে। একে এতটা
দূর, তাতে এই করোনার উৎপাত। সন্তু, অতীনের মতো দু’-তিনজনই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছিল অফিস থেকে। দিন পনেরো হল কলকাতায়
বউ নিয়ে এসেছে অনির্বাণ। মেস ছেড়ে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। আর আমরাও পিছনে পড়ে গেছি সমানে।
কীরে খাওয়াবি না?
বউ দেখাবি না?
যদিও ফেসবুকের কল্যাণে
ওর বিয়ের ফটো দেখতে আর বাকি নেই আমাদের। দারুণ সুন্দরী বউ হয়েছে অনির্বাণের। একেবারে
পাওলি দামের মুখ। তার সঙ্গে স্বস্তিকার মতো গায়ের রং।
আজ বিকেলে আমাদের
নিমন্ত্রণ করেছে অনির্বাণ। চিনারপার্কের কাছে ওর নতুন ফ্ল্যাট। নিউটউন অফিস থেকে
যেতে সুবিধা। সবাই ঠিক করলাম পাঁচটায় এয়ারপোর্ট এক নম্বরে মিয়ো আমোরের
সামনে দেখা করব। আমি, সন্তু, অতীন, কৌশিক, পিয়াল, আমাদের টিমলিড সুরজিৎদা—
সবাই পাঁচটা দশের মধ্যেই পৌঁছে গিয়েছিলাম। দেখা নেই শুধু তনুশ্রী, মৌমিতা আর
শ্রীতমার। শেষ পর্যন্ত পৌনে ছ’টায়
এসে পৌঁছলেন তিন মহারানি। তাও নাগেরবাজারের পিজি থেকে ওঁদের নাকি সাজতে দেরি হয়ে
গেছে। তাও যে কী ছাই সেজেছে, বুঝতে পারলাম না।
লেগপুল করার এসব সুযোগ
ছাড়ে না সন্তু, যতই সাজ, অনির বউয়ের ধারেকাছেও পৌঁছতে পারবি না কিন্তু...
তিনজনেই মুখ বেঁকাল। একটা কথা ঠিক। মেয়েরা কিন্তু আজকাল মেয়েদের জ্বালানোর
জন্যই সাজে।
যাই হোক, সওয়া ছ’টাতেই
আমরা পৌঁছে গেলাম অনির্বানের ফ্ল্যাটে।
এয়ারপোর্টের মসজিদের সামনে থেকে নিয়ে নেওয়া হয়েছিল একটা ভালো ফুলের বোকে আর ওদের
নতুন সংসারের জন্য একটা মাইক্রোওভেন। কলিংবেল বাজাতে দু’-এক মিনিট পর একটা
অল্পবয়সি বউ এসে দরজা খুলে দিল। কী ব্যাপার। অনিদের তো দু’জনেরই থাকার কথা। বউটির রং
একটু চাপার দিকে। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা।
সিঁথিতে হালকা সিঁদুর। মুখেচোখে অল্প প্রসাধনী। পরনে হলুদ জামদানি। সন্তু আর
অতীন সামনেই ছিল। বলে উঠল, অনি মানে অনির্বান আছে?
বউটি বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ,
ভেতরে আসুন। কেমন আছেন আপনারা। বিয়ের পর আজই তো প্রথম দেখা
হল।
সন্তু আর অতীন মুখ চাওয়াচাওয়ি
করল। বেশ বুঝতে পারছি অনির কোনো আত্মীয়া।
বিয়েবাড়িতে ছিলেন। ওরা আর চিনতে পারছে না। ইতিমধ্যে অনি এসে গেছে, আরে আরে, তোরা এত দেরি করলি!
ড্রয়িংরুমটা বেশ সুন্দর
সাজিয়েছে অনির বউ।
সোফা, ডিভান, ছোট টি-টেবল। দেয়ালের একদিকে টিভি। আর-একদিকে একটা ছোট কাচের শোকেসে নানারকম পুতুল আর কিছু বাংলা উপন্যাস আর
গল্পের বই। শোকেসের ওপর ওদের বিয়ের
ফটো।
অনি সবাইকে বসতে বলে
ভিতরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এল অনি। সঙ্গে সেই দরজা খুলে দেওয়া বউটি। দু’জনের হাতে ট্রে-তে শরবতের
গ্লাস। টেবিল ট্রে-টা রাখতেই সন্তু ছোঁ মেরে নিয়ে নিল। অনি বউটিকে বলল, তোর্সা তোমার সাথে তো সন্তু আর অতীনের আলাপ আছেই। বাকিদের
আলাপ করিয়ে দি...
সন্তু সবে এক ঢোঁক শরবত
গলায় চালান করেছিল। বিষম-টিসম খেয়ে একাক্কার। বাকিদেরও দেখলাম গোল গোল চোখে বউটিকে নিরীক্ষণ করতে। পিয়াল কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, আবার বিয়ে করল নাকি? কৌশিক
আবার উত্তরে বলল, বুঝতে পারছি না। সবাই
চুপচাপ হয়ে গেছে। একেবারে বেলুনের হাওয়া
বেরোনোর মতো অবস্থা।
সন্ধেটা অবশ্য ভালোই
কাটল। স্টার্টারে ছিল কাবাব আর ফিশ কাটলেট। মেইনকোর্সে বিরিয়ানি, মটন চাপ, ফিরনি আর আইসক্রিম। কিন্তু সুর-তালটা কেটে গিয়েছিল আগেই। যদিও তোর্সার সঙ্গে ভালোই
গল্পগাছা হল। বলছিল, এখানে এসে
সারাদিন একা-একা ভালোলাগে না। মাস্টার্সে
অ্যাডমিশন নেবে ভাবছে। দারুণ মিষ্টি মেয়েটা।
ন’টা নাগাদ অনির ফ্ল্যাট
থেকে বেরোলাম আমরা। বেরোনোর পরও সবাই চুপচাপ। নীরবতা ভাঙল শ্রীতমা। ‘দেখলি মেকওভারের খেল’ বলে হিহি করে হাসতে লাগল। আমি খুব চাপে পড়ে গেলাম। প্রেম-ট্রেম
করতে পারিনি। বাড়ি থেকে মেয়ে দেখছে। ভগবানে ভরসা!
No comments:
Post a Comment