একটি
নিছক
রাজনৈতিক গপ্পো
পাশের
বাড়ির গোয়াল। তার
পাশেই ঘরখানা। সন্ধের
মিহি আলোয় মায়াময়
লাগে ঘরটাকে। বত্রিশ
বছরের শ্বশুরের ভিটে
আজও তেমনই। অলংকার
তো বাহুল্য। চামড়ায়
খসখসে ভাব। দিনদিন
বুনোফুল হয়ে উঠছে। ভগ্নদশার একশেষ। টালি
চাপানো চাল। ধারীর
প্রায় পুরো দেহটাই
ধসে গিয়ে পেছনের
পুকুরে গিয়ে পড়েছে
বৃষ্টির প্রশ্রয়ে। এই
যাতায়াত ফি বর্ষায়
লেগেই থাকে। সন্ধ্যার
গায়ে গা লাগিয়ে
জোনাকি আর প্যাঁচার
উড়ে যাওয়ার মতো
করে বৃষ্টি আর
জ্যোৎস্না ভেসে যায়। ছড়িয়ে যায় কখনও
ঘরের ভেতরে। কাক-বক
বাড়ি ফিরলে সন্ধে
আসে এখানেও। মাঠ
থেকে মুড়ে খাওয়া
ঘাস মাড়িয়ে গরুর
পাল নিয়ে আসে
গোটা পাড়া। হীরার
ঘরে গরু নেই। হীরার বউয়ের রাত
আসে তাড়াতাড়ি।
ঘরের সামনে
এক চাকলা ঘাস
গজানো খামারের মতো
হীরার বউয়ের শিক্ষা
আর দীক্ষা। মাটিগুলো
ধুয়ে যাওয়ার সমস্ত
সম্ভাবনা নিয়ে আটকে
আছে। এম. এ পাশ আর সংস্কার
দুটোই একসময় সুমিতার
অহংকার ছিল। তারপর
দশ বছরের স্বামী
আর সাত বছরের
ছেলে নিয়ে সংসার
টানতে টানতে যখন
সে হীরার বউ
হয়ে উঠল পাকাপাকি ভাবে, তখন
থেকে খামারের ঘাসগুলো
বোঝা যায় স্পষ্ট।
এই পচা
ভাদ্রেও একখানি মেঘের
টুকরো নির্ভুল লক্ষ্যে
এসে দাঁড়িয়েছে হীরার
বউয়ের মাথার উপর। শিরশির
হীরার বউ। এখন
সেই সময়। বাতাস
এখন ঘরের পশ্চিমের
জামগাছের বুড়ো পাতাকে
নিয়ে এসে ফেলে
খামারের ঘাসের মাথায়
মাথায় স্বামী আর
ছেলের উপর দিয়ে। অজান্তে। মাথায় কাপড়
দেয় হীরার বউ। ঘামে ভেজা শরীরটা
একটু আবেশ পায়। অন্যের গোয়াল। সেই
গোয়ালের গরুগুলোকে ভরসন্ধ্যায়
খড় দেয় হীরার
বউ। খড় আঁটির
গিঁট খোলে না। চারপাশে তাকিয়ে ছুঁড়ে
দেয় গরুগুলোর মুখের
সামনে। ঘরের পেছনে
জামগাছের কালো অন্ধকারে
কুয়াশা ঘষা আলো
পড়ে। মাথার কাপড় আর-একটু
নামে। গরুগুলো আঁটি
বাঁধা খড় নিয়ে
বিরক্ত। ম্যাকের মাথায়
খড়ের আছাড় খাওয়ার
শব্দ আর ঘরের
ভেতর ক্লান্ত চিন্তিত
দুটো শরীরের উপর
পাখার ঘ্যাসঘ্যাসানি। হীরার
বউ শব্দের ঘাড়ে
চুপিচুপি পা ফেলে
অকুণ্ঠে। মনে হয়,
এমন সব শব্দের
কাছে সে কৃতজ্ঞ। নতজানু
হয়ে থাকতে চায়। যাব কি যাব
না! এমন ভাবনা
প্রথম দিকে এলেও,
এখন হীরার বউ
দ্বিধাহীন। শাপলার ডাঁটার
মতো। যে কোনোভাবে শাপলাকে
জলে ভাসিয়ে রাখাই
তার উদ্দেশ্য।
ঘরের উঠোন
থেকে পাশের গলি
দিয়ে পেছনের জামতলা
ডান পায়ের এগারো
পা। মাটির দালান
ধোয়া হয়ে গেছে
হীরার বউয়ের পাছার
মতো। গলার হাড়
ঠেলে বেরিয়ে আসছে
দিন দিন ছিটাবেড়ার
সঙ্গে। দালানের ঈশান
কোণে মাটির তুলসিমঞ্চ। টবের ওপর পতপত
ধোঁয়া উঠছে গুমরে
মরা আগুন থেকে। একটু আগে ওখানে
হাঁটু গেড়ে বসেছিল
ব্লাউজহীন হীরার বউ। রোগাটে গড়ন। দশ
বছর আগে একদিন
এই তুলসিমঞ্চের সামনেই
আলো ঝলমলে রাতে
সাতপাক খায় সুমিতা। সামনে হীরেন। সব
মন্ত্র ঠিকঠাক উচ্চারণ
করেছিল দু’জনে। পরদিন
সন্ধ্যায় ঘরের পেছনের
পুকুরপাড়ে সোজা দাঁড়িয়ে
থাকা বেলগাছটার দিকে
আঙুল উঁচিয়ে পাড়ার
এক নিকট বয়স্কা
বলেছিলেন— ‘হথায় তমাদের পুব্বপুরুষরা
থাকে। গড় করো
মা।’ যন্ত্রচালিতের মতো
হাতজোড় করেছিল সুমিতা।
আইবুড়ো থাকতে
কিংবা বিয়ের প্রথম
দিকটাতে সুমিতা অসাম্য
নিয়ে ভাবত। পড়াশোনা
করা সাম্যবাদ নয়,
রীতিমতো সরেজমিনে। হীরেন
তখন একটা বেসরকারি
স্কুলে ইংরেজির শিক্ষক। হীরেন তখন এম.
এ যুবক। সুমিতার
ডবকা বুক। পাছায়
মাংস। মনে রাষ্ট্র
আর সমাজের নানা
চিন্তা। ক্লজ আর
আর্টিকল নিয়ে সংসার
চলে বেশ। বসন্ত
আসে। ভোগ করে। কোকিল ডাকে অবিরাম। অক্লান্ত বাসনা ঘর
জুড়ে ম ম করে। হীরেন ছাড়া
সুমিতার মনে ধাপ
কেটে কেটে সিঁড়ি
বানিয়েছে রাষ্ট্র-সংবিধান-গণতন্ত্র আর দলীয়
রাজনীতি। এসব কিছু
নিয়ে একটা শেষ
সিদ্ধান্তের খোঁজে আছে
সুমিতা।
কী থেকে
কী হয়ে গেল!
কর্মী ছাঁটাইয়ের তালিকায়
নাম এল হীরেনের। মনমরা হীরেন ঘরের
কোণে বসে থাকতে
থাকতে হীরা হয়ে
যায়। বিটুইন থেকে
অ্যামং হয়। কোকিল
ডাকলে বাই-এর
জায়গায় অ্যামং ভাবে
সে। প্রতি ভাদ্রে
গুমোট এলে ভ্যাপসা
ঘামের সঙ্গে দুর্গন্ধের
মতন অবসাদ নামে
হীরার শরীর চুঁয়ে। কাঁপা কাঁপা শ্বাস
ভারী হয়ে জানালার
বেড়া দিয়ে তুলসিমঞ্চে
আছাড় খায়। আছাড়ের
গর্তে ভাদ্রের শিশির
জমে। যে শিশির
পাথর কানা করে। তবু একপলা শিশির
জমে থাকে সকালের
সূর্য অবধি। কোনো
কোনোদিন হীরা অ্যাবাউট
প্রিপোজিশন নিয়ে ভাবতে
ভাবতে ভেজা কাগজের
মতন ল্যাদল্যাদে চাউনি
ফেলে বেলগাছটার মাথায়,
যেখানে একটা গ্রহ
অন্যের আলো ধার
করে ঋণী হয়ে
আছে। ভাদ্রের বয়স্ক
মেঘ মুছে দেয়
হীরার দৃষ্টি। কখনও
কখনও হীরার বউ সন্ধ্যা
দিয়ে খোলা ব্লাউজে
ঘামাচির দানা গালতে
গালতে হীরার অবসাদে
এসে বসে। ছেলের
কপালে হাত বোলায়। আর অন্ধকারের নদী
হয়ে যাওয়া হীরার
বুকে ওয়াটারলু হয়ে
মিলিয়ে যায়। গোটা
গোটা ভাত থেকে
খুদসেদ্ধ হয়ে যাওয়া
সংসারটা ক্রমে মজে
যাওয়া উনুনের শিকল
হয়ে থাকে।
এখন হীরার
বউয়ের কাছে ছেলে
আর হীরা রাষ্ট্র
হয়ে আছে। সবজি
আর গোটা গোটা
ফুটন্ত চাল সংবিধানের
তীব্র আলোয় ভরা
আর্টিকেলের পূর্ণচ্ছেদগুলোর ছায়ায়
ঘাপটি মেরে আছে। এখন সে শুধু
অদেখা, না-শোনা,
না-মানা জায়গায়
তন্ন তন্ন হাতড়ায়।
অন্ধকারে গরুগুলো
গিঁটবাঁধা আঁটি আছড়ায়
ম্যাকের মাথায়। পা
পিটে পিটে অস্থির
লোভে মাথা নাড়ে। চাগড়া মেঘটা এখনও
বেলগাছের মাথায় গ্যাঁট
হয়ে বসে আছে। হীরার বউ চোখ
বুজিয়ে বেলগাছটাকে প্রণাম
করে। গরুগুলো খড়
চিবানোর খড়খাড় শব্দ
করছে। তার সুযোগ
নিয়ে হীরার বউ
পা ফেলে ফেলে
আসে জামতলায়। মাটি
বড্ড খটখটে। হীরার
বউ পুকুরের রাস্তা
দিয়ে ঘুরপথে চোখ
নিয়ে গিয়ে ফেলে
বেলগাছের তলায়। অন্ধকার
উনুনের অভ্যাসে দেখতে
পায় ছায়াটাকে। বেলগাছ
থেকে সরে আসে
পাড় ধরে। এখন
হীরার বউয়ের বুকোবুকি
সেই ছায়াটা।
লোকটার ধুতি
পায়ের বুক ঢেকে
রেখেছে। গায়ে ছোপ
ছোপ চেক জমা। মাথায় কালো ফেজ
টুপি। বোধহয় অন্ধকারকে
ধোঁকা দেওয়ার জন্যই। হিমশীতল মুখ। বুকের
মাঝখান দিয়ে একটা
পবিত্র নদী নেমে
গেছে। লোমগুলো ঝুঁকে
পড়ে জল তুলছে
আপনমনে। কাঁধ হিমালয়ের
শক্ত পাদদেশের মতন। ঘাড় কাত করে
সহজে লালা ঝরিয়ে
দেওয়া যায়। মানচিত্রের
মতন এবড়োখেবড়ো শরীর। দু’হাত বাড়িয়ে
হীরার বউকে কাছে
টানতে গেলে বামহাত
একটু বেশিই লম্বা
মনে হয় তার। তাকে ছায়াই মনে
হয় হীরার বউয়ের। এতদিন যাওয়া আসা
করছে সে। অন্ধকারে
প্রায় প্রতিদিন। কিন্তু
হীরার বউয়ের কাছে
সে শরীর হিসাবে
ধরা দেয় না। ধরা পড়ে না
কিছুই। একটা অ্যাবসলিউট
অ্যাবস্ট্রাক্ট।
হীরার বউ
আগাগোড়া সমতল। দাঁড়িয়ে
আছে ছায়ামূর্তিটার মুখোমুখি। চুল খুলে খালি
পিঠে ঘষা খাচ্ছে। শরীরে তার উনুন
জ্বলেছে যেন। ঘুঁটে
ফেলছে কেউ। পুড়ছে
গুমরে গুমরে। ভাত
ফুটছে গোটা গোটা।
ডুবছে
তাত নিচ্ছে
ভাসছে
আবার ডুবছে।
এইমাত্র একটা
ধারালো বঁটি আলুর
পোশাক খুলে ঢুকে
গেছে ভেতরে। ভাতের
সঙ্গে ভাসবে। গা
ঢলাঢলি।
—কতবার বলছি, পাছাটায় আর বুকটায় মাংস ধরা একটু...
এইসময় হীরার
বউয়ের মনে কতবার
সেই মোটা মূল্যবান
বইটার ছবি এসেছে। ভারী চোখ নিয়ে
একজন বসে বসে
তার পাতা উল্টাচ্ছে। পেনসিল দিয়ে দাগ
কাটছে। বাইরে দু’জন
মুখ ঢাকা দারোয়ান। লোকটা ভ্রূ কুঁচকে
বারবার চেষ্টা করছে
বিটুইন দ্য ওয়ার্ডস
দেখার। ব্যর্থ হচ্ছে। উঠে দাঁড়াচ্ছে। চোখে
মুখে ভাদ্র-বিরক্তি। মাথায় ঠেকিয়ে প্রণাম
করছে বইটা। বেরিয়ে
যাচ্ছে ঘর থেকে।
—তোর জেল্লাটা এখন আরও বাড়ছে রে…
—কাল
একটু তাড়াতাড়ি আসবি।
যে মেঘটা
ঠায় দাঁড়িয়েছিল, বৃষ্টি
ঝাড়ল অঝোর। পাতাগুলো
কেঁপে কেঁপে ধুয়ে
ফেলল নিজেদের। গরুগুলো
আঁটি খোলার আনন্দে
মাথা নেড়ে শব্দ
তোলে কানে। উঠে
দাঁড়ায় হীরার বউ। জামতলায় সে নিজের
শুকনো শোয়ানো ছায়া
দেখে। সমতল। দুটো
বিশাল পা চলে
গেছে পাড় ধরে
বৃষ্টি ফেলে।
জানালার বেড়া
দিয়ে হীরার অবসাদে
ধাক্কা দেয় আধফোটা
ভাতের নির্জল শরীর। অ্যামং-এ জল
ঢেলে বিছানায় এসে
বসে সে। ভাতের
পেছনে পেছনে সে
এখন ভাবতে পারে,
প্রিপোজিশনের কোনো পূর্বনির্ধারিত
পজিশন থাকে না। নিয়মের পোশাক খুলে
আদুড় ভাতগুলো যেমন
টোকা মারে একে
অন্যে।
মরা আগুন
রাতভোর একটানা তাকিয়ে
থাকে হীরার বউয়ের
দিকে। চাক চাক
ফ্যান চিটচিটে ভাব
নিয়ে গেঁথে আছে
হীরার বউয়ে আর
সেই মূল্যবান বইটার
ফাঁকা মার্জিন বরাবর।
দারুণ!
ReplyDeleteভাই আমার
Deleteএই গদ্য ভাষা ও উপমার ব্যবহার দেখে মুগ্ধ হচ্ছি। প্রচণ্ড ভালো লেখা ।
ReplyDeleteঅসংখ্য ধন্যবাদ
Deleteআপনার গল্পটি পড়ে মুগ্ধ হলাম।খুব ভালো গল্প।
ReplyDeleteআপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই।
ReplyDelete