বাক্‌ ১৪৯ ।। অনিন্দ্য রায়

 

শুশ্রূষা পেরিয়ে

 

শুশ্রূষা পেরিয়ে এলে বৃষ্টি শুরু, করমচার ঝোপ

ভয়ের চৌষট্টি টাকা দিতে হয় স্পর্শে প্রতিবার

মুণ্ডু বার করে আগে ফরসেপে গিঁটের মাথা বাঁধে

কাটে তরোয়াল দিয়ে, টুঁ শব্দটি নেই, ততক্ষণে

রাত্রি শেষ, ততক্ষণে সম্বৃদ্ধি খালাস, সংজ্ঞাহারা 

 

জিভের ওপরে ঝোলে, অধিবিদ্যা, প্রতিশোধ, টোপ

এ শহরে কোনওদিন অভাব ছিল না প্রতিভার

একাকী পেয়েছে যেই পুষ্ট হাত রেখেছিল কাঁধে  

সে হাত শিশ্নের মতো, সে হাত সর্পের মতো বনে

এখানে কেবলই হাত, নীল শিরা, পাজির পাঝাড়া 

 

এখানে ওষুধ শুধু, নিশ্চিন্তে শিরায় ঢোকে ডোপ

সিরিঞ্জ ফেলেছে ছুড়ে, তৎক্ষণাৎ একশো ফিভার

নিশ্বাসের ঝঞ্ঝা লেগে আস্থিমাংস উড়ে গেছে চাঁদে   

শুধু চামড়া আর চক্ষু আর জিহ্বা রয়েছে জীবনে

মানুষের দেহে, দেখি, জন্ম নিচ্ছে শত-কোটি তারা

 

আজ সব ঝরে পড়ল, জ্ঞান ফিরলে সামান্য কি কাঁদে

অথবা নিজের হাতে দেয় জলে ডুবিয়ে গোপনে

সে জল বৃষ্টির মতো ডুবিয়েছে আমাদের পাড়া  

 

অপঘাত

 

কে আসে রুটির মতো? হাড়ের সুরুয়া আসে কে যে!

একটুও না দেরি করে মুখ দেয়, ছিঁড়ে ফেলে দাঁতে

পাত্তাই দেয় না ব্যথা, আটকালে প্রবল হয় আরও

শেষে মুখ ধুয়ে তোলে বিকট উদ্গার! সামাজিক!   

ঠোঁটের হলদেটে ছোপ, গায়ে ঘাম, পা টলে, হারামি  

 

সন্ধে থেকে বসে আছে পরিপাটি, নৈশভোজ সেজে  

নিজের শরীরে অল্প বিষ মেখেছিল গতরাতে

না হয়নি কাজ তাতে, আজ তাই একটু বেশী গাঢ়

হয়ে উঠতে চায়, তবে আজ নেশা হোক না খানিক

সশব্দে ওলটাক গ্লাস, মেঝে জুড়ে গড়াক নষ্টামি   

 

কখনও পড়ে না মনে কোনওদিন দুপুরে কলেজে

জলের বোতল হয়ে ছিপি খুলেছিল নিজহাতে

কেউ পান করতে চাইলে, বলেছিল, “কী হচ্ছে কী! ছাড়ো”

সে জল এখনও আছে, মিশেছে কয়েকটি দান ঠিক

স্বাদ কি বেড়েছে তাতে! সে তরল আজ দূরগামী

 

সকালে খুলবে না দরজা, মেঘে মেঘে বেলা হবে আরও

অবশেষে ভাঙা হবে, দেখা যাবে দেয়ালে স্বস্তিক 

ছড়িয়ে রয়েছে ঘরে বডি, ফুল, সিঁদুর, প্রণামী 

 

...

 

ভূতেদের বাড়ি

 

বেজে যাচ্ছে সারাক্ষণ, তেঁতুলপাতার মতো বাড়ি

বেজে যাচ্ছে সারাক্ষণ, হাওয়া নিজে বায়েন তাহলে

কখন বেরিয়ে যাচ্ছে, কখন ঢোকে যে, বোঝা দায়

কোন দরজাটিতে পুং, স্ত্রী কোনটিতে নির্ধারিত? নয়?

বেজে যাচ্ছে সারাক্ষণ, টিনড্রাম, থামে না সহজে  

 

কে ঢোকে লুকিয়ে? চোর? হত্যাকারী? প্রেমিক? ভিখারি?  

নিজের ছায়াকে রাখে হট্টগোলে, উল্লাসের তলে

কেউ কি চেনে না? কেউ? মুখের আদল ভোলা যায়?

তুমিও চেনো না? ঠিক? তবে তাকে ধরার সময়

উঠেছ কেন যে কেঁপে! পড়ে যাও মূর্ছায় কেন যে? 

 

এত লোক! লোকারণ্য! এত মুখ! এত মারামারি!

যেন এক বাদ্য পেয়ে, অসামান্য, মেতেছে সকলে

আর সেই রুগ্ন ছায়া লুটিয়ে পড়েছে অসহায়

কেন যে তোমার চোখে ফুটে উঠছে সাংঘাতিক ভয়

ওদিকে দুখানি চোখ, হতভম্ব, তোমাকেই খোঁজে  

 

তেঁতুলপাতার বাড়ি, চিৎকার লাফাল দোতলায়

মুহূর্তে নিশ্চুপ হয়ে মিশে গেল ভূতেদের দলে

স্বাস্থ্যপান সেরে লোকে মন দিল সর্বশেষ ভোজে

 

...

 

চালকল

 

উঠোনে ছড়ানো ধান, নীচু হয়ে আসে কবুতর

বিনোদনে, মস্করায় ধুলো ওড়ে প্রাচীন রসিদে    

ভাষার বিরুদ্ধে যাব? এতদূর? এত সইবে কি?   

দেহাতি দরজায় এসে কড়া নাড়তে সাহস হল না

ভেতরে টিনের চালে জেগে উঠছে বিপুলা পৃথিবী

 

আমি কি তাদের অংশ? হাত রাখি যেখানে নজর

ছলকে উঠে পড়ে গেছে; মাথায় চড়েছে ক্রমে খিদে

কোথায় কী পাওয়া যায় এদিকে ওদিকে খুঁজে দেখি

কবুতরদের সঙ্গে ছিল না কখনও বনিবনা

আজ কি নিকটে আসবে? ভাব করতে পার হবে ঢিবি?  

 

আজ কি দু ফাঁক হয়ে ফেটে যাবে নিহিত প্রস্তর?

ঢুকে পড়ব টুক করে, লুকোচুরি যতটা সুবিধে

খেলব পাঠকের সঙ্গে, নাহলে কবিতা লেখালেখি

উত্তেজনাহীন, বাকি সব কিছু ভাষার দ্যোতনা  

কথার প্রচণ্ড ভারে বেঁকে যায় লেখকের জিভই

 

তাকেই জটিল ভাবি, বা ভেবেছি তাকেই সাবেকি

চালকলে, হেমন্তদিনে খুঁটে খাচ্ছে যা কিছু প্রেরণা

ছড়িয়ে রেখেছে সব ইহলোকে পরমান্নজীবি

...   

 

নীলকুঠি

 

শেষ বিকেলের মতো নীলকুঠি, ইঁদারা, কুহক

দেখা করতে গেছি আর সে এসেছে অশ্বত্থপাতায়

চড়ে পতঙ্গের মতো, স্পর্শমাত্র আঙুলে কুণ্ডলী

হয়ে জড়িয়েছে, আমি আরও বিরক্তিতে তেঁতো মুখে

দশবার ওয়াক করে রাজি হয়ে যাই একাদশে

 

এখানে মাটিতে পাতা বৃষমণ্ডলের জন্মছক

অমাবস্যা হলে মোছে, ফের ফুটে ওঠে পূর্ণিমায়

ওখানে সামান্য ত্রুটি রয়েছে কাকে যে ডেকে বলি

বরঞ্চ নিজের হাতে হুবহু নকশা রাখি টুকে

সে ছাপ গভীর হয়ে বসেছে, ওঠে না ঘষে ঘষে

 

তোমার তো, মনে পড়ে, হস্তরেখা জমানোর শখ

ভাবি তাই কাছে যাব, পতঙ্গটি সঙ্গে যেতে চায়

অথচ সমস্ত পথে ছড়িয়ে রেখেছ গ্রন্থাবলী   

পৌঁছতে পারি না, এত শব্দ, যতি তোমার তালুকে

তারাদের অভিমান একে একে পড়ছে, দেখি, খসে

 

শেষ বিকেলের মতো নীলকুঠি, গানের দু কলি 

একাকী শুনতে গেছি, সন্ধ্যালোকে সামান্য নাটুকে

ভঙ্গীতে পাতায় চরে এল জলবিন্দুর মতো সে

 

...   

দুপুরে

 

দুপুরের কাজ ছিল মেলে দেওয়া স্নানের পতাকা

বিকেলের কাজ ছিল তাকে তুলে আবার গোটানো

মাঝের সময়টুকু ইচ্ছে মতো, ব্যাকরণে ভুল

বিভাব কবিতা হয়ে মুখের ওপরে লেগে থাকে

আমি যত পড়তে যাই সে পৃষ্ঠা উল্টিয়ে মৃদু হাসে

 

দুপুরে লেখার মতো এ-ফোর কাগজ ছিল ফাঁকা

আমি যত লিখতে যাই বাঁদিকে মার্জিন তুমি টানো

ডাইনে আরও সরে যাই, তুমি আরও ঘন ঘন রুল

টেনে কি চ্যালেঞ্জ করো! লিখতে বলো সেভাবে আমাকে!

স্পর্শ করে বসে আছি শরীরের প্রবল উল্লাসে

 

শরীরে যাওয়ার মতো চালু ছিল দুপুরের চাকা

গড়িয়ে এসেছে আর ভেঙে গেছে ঘুমোনোর ভানও

ফুটেছে একেক করে সহস্রটি অশোকের ফুল

হঠাৎ তা দেখে থমকে গেছি ছোটোনদীটির বাঁকে  

হঠাৎ তা দেখে তুমি জলস্তর বাড়াও সকাশে   

 

দুপুরে লেখার ছলে কতটা ডুবেছি হুলুস্থুল

পতাকা সাদা না করে পড়েছি এমন দুর্বিপাকে

সমর্পন করতে আজ নিজেকেই ওড়াই বাতাসে

 

 


2 comments:

  1. ধীরে ধীরে পড়ছি। আপাতত শেষ কবিতা।। পড়লাম। আমি আগেও বলেছি, শুধু ছন্দ নয় । ফর্ম ও কন্টেন্ট, এই যে একাকার।। এটা টেনে রাখছে

    ReplyDelete
  2. এই ছন্দগুলো, সাথে শব্দের ব্যবহার, একটা ছায়াময় আবহ সৃষ্টি, সব মুগ্ধ করে রাখে কবিতাময়।

    ReplyDelete