বাক্‌ ১৪৯ ।। অনুপম বলছি

 

কবিতার বিরোধিতা করে, এমন কোনো কিছুতেই একজন কবির স্বভাবত আস্থা থাকতে পারে না, আগ্রহ অবিশ্যি থাকতে পারে। মিলটন গদ্য লিখতেই চাইতেন না। যে হাতে ‘প্যারাডাইস লস্ট’ বা ‘স্যামসন অ্যাগনিস্টিস’-এর মত কাব্য লেখেন, সেই হাতে গদ্য লিখতে তিনি ঘৃণা বোধ করতেন। হোমার একটা রম্যরচনা জাতীয় সোজাসাপটা কিছু লিখছেন, বা দান্তে একটা ফরমায়েশি নিবন্ধ লিখছেন- এ তো ভাবাই যায় না। শেকসপীয়ারের বাবার দস্তানার ব্যবসা ছিল। স্ট্যাটফোর্ডের মেয়র অবধি হয়ে গিয়েছিলেন বিকিকিনির দৌলতে। ভেড়ার লোমের ধান্দায় আর সুদের কারবারে তিনি মালামাল হয়ে যাচ্ছিলেন, গোলমাল বাঁধাল ক্যাথলিক আর প্রোটেস্টান্ট ধর্মের রেষারেষি আর তাঁর স্পাইগিরির ভূমিকা। শেকসপীয়রও কি তাঁর বাপের ব্যবসা চালাতে পারতেন? উইলিয়াম শেকসপীয়র অভিনয় ব্যবসায় নামলেন, মালামাল হয়ে গেলেন, কিন্তু স্বর্গ খুশি থাকল। তাঁর প্রতিযোগী অকালপ্রয়াত ক্রিস্টোফার মার্লোও একজন স্পাই ছিলেন, সেটা সম্ভবত রোমাঞ্চের আকর্ষণেই। মদের আড্ডায় খুন হয়ে গেলেন। কিন্তু সেই দিব্যতরুণ মার্লো কি কোনো খবরের কাগজে ফিচার লিখে সংসারী হতে পারতেন? উত্তরটা ‘না’ হলেই আমরা আশ্বস্ত হই। শেকসপীয়ার নিজেই যেমন হ্যামলেট, মিলটন যেমন স্যাটান, মার্লোও তেমনই একজন ডক্টর ফস্টাস। শাশ্বত এঁদের এমন হাতছানি দিয়েছে, আত্মা এঁরা বিক্রি করে দেবেন, কিন্তু শরীরে ময়লা লাগাবেন না। হ্যাঁ, এমনকি গদ্যের ময়লাও, যেটা আমরা এখন ঘাঁটতে বসেছি।

যতই মলয় রায়চৌধুরী-ফাল্গুনী রায় থাকুন, আমাদের অনেকেই কাছে আজও কবিতা আসলে সেই ‘পাকিজা’ সিনেমায় মীনাকুমারী সুন্দরীটির পায়ের পাতার মতো- তাকে মাটিতে রাখতে নেই, সে ময়লা হবে কিনা পরের কথা, তার রাজকুমার প্রেমিকের মন খারাপ হয়ে যাবে। সামাজিক উচ্চারণের মলিনতা তার গায়ে মানায় না। যে হাতকে কবিতা স্পর্শ করেছে, সেই হাত শুধু চন্দন বৃক্ষই রোপন করতে পারে, সে হাতে চালডাল ওজন করা বা ধানচাষ করা যেন আর মানায় না। স্বর্গ তাতে নারাজ হবে। মর্ত্য তাঁর ইম্মর্টালিটি খারিজ করে দেবে। এটা লিখেই খেয়াল হল- অমরত্ব আর immortality শব্দদুটোর মধ্যে প্রায় যমজ ভাইয়ের মতো মিল, নাকি বাবা আর ছেলের মুখ মিলে গেল! দুটো আলাদা ভাষার দুটো শব্দকে দেখে মাঝেমধ্যে কেমন যেন মনে হয় অমিতাভ বচ্চন আর অভিষেক বচ্চন পাশাপাশি বসতে চাইছেন, কিন্তু মাঝখানে একজন জয়া বচ্চন, ইয়ে, জয়া ভাদুড়ী।

কবিতার শত্রুদের আমি বিশ্বাস করি না। ভালোবাসতে পারি না। অ্যান্টিপোয়েট্রি নামটাতে যে আমার বিশ্বাস নেই সেটা বিবিধ প্রসঙ্গে বলেছি। সত্যিই কবিতার অ্যান্টি কিছু হয় কি? হলেও সেটাকে আবার পোয়েট্রি বলার কী আছে? অ্যান্টি-ভাইরাস ঠিক আছে। এমনকি অ্যান্টিক্রাইস্ট-টাইস্ট অবধি সইতে পারি, কোনো-কোনো কবি একটু অ্যান্টি-সোশ্যাল টাইপের, স্বীকার করতে পারি। তার বেশি নয়। কবিতার বিরোধিতা করে আপনি পা রাখবেন কোথায়? চাঁদে? সেটাই আপনাকে করতে হবে, কারন বিশেষ করে আমাদের বাংলা কবিতার কোনো সামাজিক গুরুত্ব গত ৫০ বছরে নেই। আর অ্যান্টি-পোয়েট্রি বলে যে ধারণাটিকে চালানোর চেষ্টা হয়, সে তো অচল কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কবিতার প্রতি সমকালীন সমাজের মান্যতা ও সম্ভ্রমের বলয়টিকে আক্রমণ করার ইচ্ছে থেকে গড়ে ওঠে। সমাজ ছাড়া প্রচলিত কবিতার অচল ব্যাপারটাও নেই। ‘সমাজ যে কবিতাকে মেনেছে- তাকে আমি লিখব না’- এই হল সোজা মনোভাব। ‘আমি অন্য প্রতিমা গড়ব’- এই হল সোজা আকাঙ্ক্ষা। যারা অ্যান্টিপোয়েট্রি লিখতে চান, তাঁরা কবিতার সেই গুণগুলোকে খুব সচেতনভাবে নিজেদের কবিতা থেকে বাদ দ্যান, যেগুলোকে সমাজ কম্পালসারি মনে করছে, যেগুলো ছাড়া বড় প্রতিষ্ঠানে কবিরা জায়গা পাচ্ছেন না। এ এক বিদ্রোহ, যে কোনো নতুন এবং স্বাধীনতাসন্ধানী কবির।

কবিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শেষ অবধি কবিতার স্বপক্ষেই যায়। কবিতার মৃত্যু নেই, তার মৃত্যুই তার জন্ম। কিন্তু লিখতে এসে একজন কবিকে আগেই যেটা করতে হয়, প্রচলিত কবিতার সেই ধাঁচাটাকে ভাঙতে হয়, যেটা আসলে একটা গরাদহীন খাঁচা। বাল্মিকীর সে চাপ ছিল না, তাঁর আগেকার কোনো ধারণা নিয়ে তাঁকে কাজ শুরু করতে হয়নি, শুধু ক্রৌঞ্চমিথুনই পর্যাপ্ত ছিল। কিন্তু এমনকি কালিদাসও সে সুবিধে পাননি। তাঁকেও প্রচলিতকে ভাঙতে হয়েছে- তাঁর আগে যা কিছু লেখালেখি হয়েছিল, কালিদাস তার ধ্বংসসাধন করেছিলেন, একমাত্র ভাস ছাড়া কেউ তাঁর মহাপ্লাবনের সামনে টিকতে পারেননি। কালিদাসকে কিন্তু আজও মুছে ফ্যালা গেল না। তিনি আছেন। মাইকেল তাঁর সময়ে এই একই কাজ করেছেন, রবিবাবু করেছেন আজও রবিবাবু বহাল তবিয়তে আছেন। তাঁর পরে আর কোনো বন্যা আসেনি বাংলা কবিতায়। মাঝেমধ্যে ভারি বা হাল্কা জোয়ার এসেছে, আবার নিজের নিয়মেই ভাঁটা ফিরেছে। আমাদের সকল গান আজও তাঁকে লক্ষ্য করে। আমাদের কিছু থুতু আজও তাঁর আকাশটির দিকে নিক্ষিপ্ত হয়। তিনি আকাশ, তিনিই আকাশের ঈশ্বরভাবনা। তাঁকে দেবতা ভাবা চলবে না। তিনি শুধুই খেলার আনন্দ, আমাদের নিয়ে খেলার। তিনি তাই এসেছিলেন নেমে, আমাদের মধ্যে।

ইয়ে, কেউ কি জীবনানন্দ দাশের কথা বলছেন? আমার মতে উনি বন্যা নন। জোয়ার বলা যায়। স্নান করতে নামা অনেক লোককেই অবিশ্যি ভাসিয়ে নিয়ে গেছেন। 

                                                                                  অনুপম মুখোপাধ্যায়

                                                                                  পরিচালক- বাক্‌ অনলাইন